শনিবার ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পদ্মা সেতু গর্বিত বাঙালির এক স্বপ্ন যাত্রা

পান্না কুমার রায় রজত   |   শনিবার, ০২ জুলাই ২০২২   |   প্রিন্ট   |   212 বার পঠিত

পদ্মা সেতু গর্বিত বাঙালির এক স্বপ্ন যাত্রা

পদ্মা সেতু আজ স্বপ্ন নয়, বাস্তব। পদ্মা সেতু আমাদের গৌরব, মর্যাদা আর আর্থিক সক্ষমতার প্রতীক। ৮ জুলাই ২০১২ জাতীয় সংসদ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। এরপর সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর শুরু হয় পদ্মা বহুমুুখী সড়ক ও রেল সেতুর নির্মাণ কাজ। একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক, বিশ্ব ব্যাংকের দুর্নীতির কল্পিত অভিযোগ তুলে বিশ্ব ব্যাংক যখন অর্থায়ন স্থগিত করে এবং অন্য দাতা সংস্থাগুলোও তখন বিশ^ ব্যাংকের অনুসরণ করে। উন্নয়ন সংস্থাসমূহের ঋণ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন কাজ শুরু করার আগে সরকারকে দু’টো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। প্রথম চ্যালেঞ্জ দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। এ লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে সম্পদ বৃদ্ধির জন্য করারোপ এবং অনেক নতুন খাতকে ভ্যাটের আওতাভুক্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিশেষভাবে বিবেচনা রাখতে হয়েছে যাতে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্থ না হয়। দ্বিতীয়ত, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান স্বাভাবিক রাখার বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। সরকার অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে সম্পদ আহরণের প্রচেষ্টায় সাফল্য অর্জন করে।

পদ্মা সেতুর মত কোন বৃহদায়তন উন্নয়ন প্রকল্পের নিজস্ব অর্থে সম্ভব কিনা তা নিয়েও বিভিন্ন মহল সংশয় প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলেছেন, এটা নেহায়েত সরকারের একটি রাজনৈতিক চমক। বাস্তবতার সাথে কোন মিল নেই। নিজস্ব অর্থায়নে এমন একটি সেতু নির্মাণ করতে যাওয়ার কাজটি সহজ ছিল না। বিশ^ ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ করেও ঘুষ ও দুর্নীতির কল্পিত অভিযোগে উত্থাপন করে তা প্রত্যাহার করেছিল। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলা নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরো বিশদভাবে বলতে গেলে, এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রত্যেকটি প্রকল্পেরই প্রাথমিক উপকারভোগী থাকে, যারা এটি থেকে সৃষ্ট সুবিধাসমূহ ভোগ করে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় তিন কোটি লোক বসবাস করে যারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রাথমিক উপকারভোগী। এ অঞ্চলের লোকজন ঢাকায় যাতায়াতে ফেরী এবং লঞ্চের উপর নির্ভরশীল। পদ্মা সেতু নির্মিত হবার কারণে এই এলাকার লোকজনের ঢাকাসহ সমগ্র দেশে যাতায়াত সহজ হবে যেটা তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসায় ও প্রযুক্তিসহ সার্বিক উন্নয়নকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। গোপালগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মোতাবেক, গোপালগঞ্জের পাঁচ উপজেলায় ১১৪টি বিল, ১২৫টি খাল, ৫টি নদী ও ৬টি বাওড় রয়েছে। সব মিলিয়ে জেলায় ৪০ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। প্রতি কেজি মাছ গড়ে ২০০ টাকা কেজি দরে চাষি ও মৎস্যজীবীরা বিক্রি করেন। সে হিসেবে এ জেলায় ৮১৯ কোটি ৪ লাখ টাকার মাছ উৎপাদিত হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে সরাসরি ঢাকায় মাছ বিক্রি করতে পারবে। প্রতি কেজি মাছে তারা অন্তত ৫০ টাকা বেশি পাবেন। সে হিসেবে গোপালগঞ্জে মাছে আয় বাড়বে ২০৫ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুকে ঘিরে এ অঞ্চলে মৎস্য চাষ বৃদ্ধি, মৎস্য ও কৃষি নির্ভর শিল্প স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দু’টি নৌ বন্দরের একটি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত। একটি মোংলা বন্দর এটার সংশ্লিষ্ট পরিবহন ব্যবস্থায় পদ্মা সেতু ব্যবহারের বিকল্প নেই। সেতু দ্বারা সৃষ্ট যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি বন্দরটির সম্ভাব্য উপযুক্ত গ্রহণযোগ্যতা ও উপকারিতা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ নদী পথে বাণিজ্য করা দেশগুলোর সাথে অধিক ব্যবসায়িক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারবে। ফলে দেশের সার্বিক বাণিজ্যের উন্নতি সাধিত হবে এবং জাতীয় উন্নয়নের কার্যকরী প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। কারণ জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নই জাতীয় উন্নয়নের বৃদ্ধি ঘটায়। আর পরিবহন ব্যবস্থা জাতীয় অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে।

পদ্মা সেতুর প্রভাবে আমদানি-রপ্তানি বাড়বে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরে। ভোমরা স্থলবন্দরের তথ্য মোতাবেক, তৃতীয় বৃহত্তম স্থল বন্দরটিতে প্রতিদিন চার শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক ভারত থেকে প্রবেশ করছে আর বাংলাদেশে আমদানি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত রয়েছেন পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী। এরপর এসব পণ্য রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে কম সময়ে পণ্য পৌঁছে যাবে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারবে কারণ তখন তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো সমগ্র দেশে পৌঁছাতে বর্তমান সময়ের চেয়ে সহজ হবে। এই এলাকায় অবস্থিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগী হয়ে উঠবে। এতে পণ্যের সার্বিক মান বৃদ্ধি পাবে এবং তাদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্র ও বিস্তৃত হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এই এলাকায় জমির মানও বৃদ্ধি পাবে কারণ সেগুলো পূর্বের তুলনায় যে কোন কাজের জন্য অধিক যথোপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। এডিবির সমীক্ষা বলছে, পদ্মা সেতু দিয়ে ২০২২ সালে যে ২৪ হাজার যানবাহন চলবে তার মধ্যে বাস চলবে ৮ হাজার ২০৮টি, ট্রাক ১০ হাজার ২৪৪টি, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলবে ৫ হাজারের বেশি। সমীক্ষায় আরো প্রতিফলন করা হয়েছে, ২০২৫ সালে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাড়াঁবে ২৭ হাজার ৮০০টি। ২০৩০ সালে হবে ৩৬ হাজার ৭৮৫টি। ২০৪০ সালে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাড়াঁবে ৫১ হাজার ৮০৭টি। পাশাপাশি জাইকার সমীক্ষাতে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের ১ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে আঞ্চলিক জিডিপি বৃদ্ধি দাড়াঁবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। দক্ষিণবঙ্গে শিল্পায়নের গতি ব্যাপক বেড়ে যাবে।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অসামান্য অবকাঠামো একটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের মধ্যে খুলনা বিভাগ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৬ শতাংশ। ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৩ শতাংশ।

বরিশাল বিভাগে মোট আমানতের সাড়ে ৪ শতাংশ। মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩ শতাংশ। পদ্মা সেতু চালু হলে ওপারে বিনিয়োগ বাড়লে ঋণের চাহিদা বাড়বে তখন ঋণের প্রবাহ বেড়ে যাবে। একই সাথে বিনিয়োগ কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক সূচকগুলো বেশি সচল হবে এবং নতুন নতুন খাত যুক্ত হলে মানুষের আয় বাড়বে। তখন সঞ্চয় বাড়বে যা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। অর্থায়ন থেকে সরে আসা বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ সরাসরি এই সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে। প্রতি বছর দারিদ্র্য কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে গড়া পদ্মা বহুমুখী সেতু আমাদের বিশ্বাস ও আস্থার সার্থক রূপায়নের নাম। আগামী ২৫ জুন সকাল ১০ টায় বহু কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ যেন গর্বিত বাঙালির এক স্বপ্ন যাত্রা।

 

Facebook Comments Box
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ২:১৩ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০২ জুলাই ২০২২

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।