বিবিএনিউজ.নেট | মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট | 775 বার পঠিত
ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণে গ্রহণযোগ্য সূচকগুলো হচ্ছে সম্পদের বিপরীতে আয়, নিট সুদ আয় ও সুদবহির্ভূত আয়। পাশাপাশি ইকুইটির বিপরীতে আয়, খেলাপি ঋণ (এনপিএল) ও মূলধনের বিপরীতে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণও এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়। তবে গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতে এ সূচকগুলোর সবক’টিতেই ধারাবাহিক অবনমন হয়েছে।
দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি আগে থেকেই নাজুক। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সরকারি ভর্তুকিনির্ভর হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এগুলো। জনগণের করের অর্থ থেকে বছরের পর বছর ধরে মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে। তবে নীতিসহায়তার নামে এবার পরোক্ষ ভর্তুকির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দক্ষতা না বাড়িয়ে দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতই এখন ভর্তুকির অনুসন্ধানে ছুটছে।
ব্যাংকের করপোরেট করহার বেশি, বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের এ যুক্তিতে ব্যাংক ব্যবসার করপোরেট করহার কমানো হয় ২ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট চলছে, এ যুক্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানো হয়। একই যুক্তিতে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার দাবি আদায় করে নিয়েছেন মালিকরা। কিন্তু বাস্তবে কমেনি ব্যাংকঋণের সুদহার। উল্টো তারল্য সংকটে টালমাটাল পরিস্থিতি এখন ব্যাংকিং খাতে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মুনাফা পরিস্থিতি ভালো দেখাতে সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এক বছরের সঞ্চিতি সংরক্ষণের জন্য দেয়া হচ্ছে তিন বছর। পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণেও ছাড় দেয়া হয়েছে অনেক ব্যাংককে। ব্যাংকিং খাতের খারাপ গ্রাহকদের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল, পুনর্গঠনের মতো বহু সুযোগ দেয়া হয়েছে। তার পরও অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপিদের মাফ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
ব্যাংক, বড় গ্রাহক, করপোরেটসহ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির বড় অংশই এভাবে ভর্তুকিনির্ভর হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একসময় দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ব্যাংকঋণে বেড়ে উঠেছে বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নীতির ক্ষেত্রে আপস ও ঋণখেলাপির সংস্কৃতি পুরো অর্থনীতিকেই ভর্তুকিনির্ভর করে তুলছে।
এ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোও নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা হারাচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো অনেক আগেই পুরোপুরি ভর্তুকিনির্ভর হয়ে পড়েছে। এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোও সে পথে হাঁটছে। বিলুপ্ত ফারমার্স ব্যাংক রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির বড় দৃষ্টান্ত।
তিনি বলেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার বিভিন্ন ধরনের ছাড় দিচ্ছে। সঞ্চিতি সংরক্ষণ, মূলধন সংরক্ষণের মতো ব্যাংকের মৌলিক বিষয়ে ছাড় দেয়াকে পরোক্ষভাবে ভর্তুকি বলা যায়। তবে আর্থিক খাতের সমৃদ্ধির জন্য ব্যাংকগুলোর উচিত নিজ পায়ে দাঁড়ানো। উত্কৃষ্ট সেবা ও আকর্ষণীয় প্রডাক্ট দিয়ে গ্রাহকদের আস্থায় নিতে হবে। অন্যথায় নীতিসহায়তা নিয়ে এগুলো বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না।
গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতে নতুন নতুন ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। কিন্তু সুশাসনের অভাব, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকের সব পর্যায়ে আর্থিক কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতি এবং খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকিং খাত নাজুক হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সম্পদের বিপরীতে আয়, ইকুইটির বিপরীতে আয়, সম্পদের বিপরীতে নিট সুদ আয় ও সুদবহির্ভূত আয়, খেলাপি ঋণ এবং মূলধনের বিপরীতে শ্রেণীকৃত ঋণের সূচকে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। যদিও প্রতি বছর নতুন শাখা খোলা হচ্ছে। নতুন শাখার পাশাপাশি নতুন কর্মী নিয়োগ, পদোন্নতি ও বেতন বাড়াতে হচ্ছে। এসব কারণে প্রতি বছর ব্যয় বাড়ছে ব্যাংকের। কিন্তু ভালো ব্যবসা করতে না পারায় একদিকে প্রতিষ্ঠানের আয় কমছে, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছে। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি নীতির ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও আপস করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিত্যনতুন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।
তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে দেয়া নীতিসহায়তাকে ভর্তুকি বলে মানতে নারাজ ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের কোনো নগদ টাকা দেয় না। পরিস্থিতির কারণেই নীতিসহায়তার প্রয়োজন হচ্ছে। গ্রাহকরা যদি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে আর ফেরত না দেয়, তাহলে আমাদের কী করার আছে। দেশের পুরো সিস্টেমের কারণে ব্যাংকিং খাতে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মামলা করে ১০ বছরেও কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির ৭০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এজন্য সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার বিষয়টি অযৌক্তিক নয়। কোনো ব্যাংক সংকটে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের স্বার্থেই নীতিসহায়তা দেয়। এটি না দিলে যেকোনো ব্যাংকই ধসে পড়বে।
আপত্তি সত্ত্বেও ২০১২ সালে নয়টি বেসরকারি ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্কালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক বিপর্যয়ের শিকার হলে সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যাংকটিকে মূলধন জোগান দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকগুলোই দীর্ঘদিন থেকে মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। প্রতি বছরই সরকার বাজেট থেকে এ ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগান দিয়ে যাচ্ছে।
মূলধন ঘাটতিতে থাকা বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যাও বাড়ছে। গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ১১টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা। এ তালিকায় রয়েছে পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংকও। যদিও ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে নয় ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। তার পরও এ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়েই চলছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতি মোকাবেলায় বন্ড ছাড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলোর প্রধান ক্রেতা হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
বিপর্যয়ের সময়েও ব্যাংক যাতে নিজের মূলধনে চলতে পারে, এজন্য প্রবর্তন করা হয় ব্যাসেল-৩। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এ ব্যাসেল বাস্তবায়নের সীমা ধরা হয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত।
যদিও বাস্তবায়নের বছরে এসে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় সব ব্যাংক ব্যাসেল-৩ তো দূরের কথা, ব্যাসেল-২-এর মানেরও নিচে নেমে গেছে। ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন থেকে ছিটকে পড়েছে বেসরকারি খাতের অন্তত ১০টি ব্যাংকও।
ব্যাসেল-৩-এর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ তারল্যের পর্যাপ্ত সংস্থান। যদিও বিদায়ী বছরজুড়ে একদম বিপরীত চিত্র দেখা গেছে ব্যাংকিং খাতে। ২০১৮ সালজুড়ে ব্যাংকগুলোয় ছিল তারল্য সংকট। এ সময়ে বেড়েছে খেলাপি ঋণও। কমেছে সঞ্চিতি সংরক্ষণের হারও। ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী পর্যাপ্ত মূলধনও সংরক্ষণ করতে পারেনি দেশের এক-তৃতীয়াংশ ব্যাংক। এ অবস্থায় চলতি বছর ব্যাংকিং খাতে ব্যাসেল-৩-এর বাস্তবায়ন অসাধ্য হয়ে উঠবে।
ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে ২০১৯ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে সাড়ে ১২ শতাংশ। যদিও বিদায়ী বছরের জুন শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এ হার ২ শতাংশে নেমে এসেছে। সরকারি বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের হার আবার ঋণাত্মক ৩১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের গড় হার ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ থাকলেও প্রায় অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে সঞ্চিতি ঘাটতিতে ছিল ১৫টি ব্যাংক। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যাই ১১। এ অবস্থায় চলতি বছরের মধ্যে বেশির ভাগ ব্যাংকের ক্ষেত্রেই ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য ব্যাসল-৩ বাস্তবায়নও পিছিয়ে দেয়ার দাবি উঠতে পারে ব্যাংকগুলো থেকে।
আগ্রাসী বিনিয়োগের কারণে ২০১৭ সালে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের অনুপাত (এডি রেশিও) নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের লাগাম টানতে এডি রেশিও কমিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আমানতের সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারবে। এর আগে এ ধারার ব্যাংকগুলোর এডি রেশিওর সর্বোচ্চ হার ছিল ৮৫ শতাংশ। সে হিসাবে সাধারণ ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও ১ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানো হয়।
দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো আমানতের সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারত। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী এ ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ এডি রেশিও হবে ৮৯ শতাংশ। সে হিসেবে এ ধারার ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমানো হয়। অবশ্য বেঁধে দেয়া এডি রেশিও সমন্বয়ের জন্য চার দফায় সময় পিছিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, এডি রেশিও নির্ধারিত মাত্রায় নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। এ নিয়েও আপত্তি জানাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির খাতায় ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকার ঋণ, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষেও দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা।
Posted ১২:২০ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed