পান্না কুমার রায় রজত | বুধবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২৪ | প্রিন্ট | 375 বার পঠিত
একুশ শতকের প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনার উত্তাল স্রোতে ভেসে ১৯৪০ এর দশকের কোনও সূচকের সাহায্যে অর্থনীতির গতি প্রকৃতিকে মাপতে চাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। জিডিপি ‘আবিস্কার’ এর পটভূমি ছিল এক অশান্ত সময়। মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের মধ্য দিয়ে মাথা তুলেছিল জিডিপি’র ধারণা। অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটস ব্যক্তি, সংস্থা এবং সরকারের সমস্ত উৎপাদনকে একযোগে পরিমাপ করতে চান এমনই একটি সংখ্যার দ্বারা, যার মান বৃদ্ধি পাবে সমৃদ্ধি-কালে আর কমতে থাকবে কঠিন সময়ে। সেই তো জিডিপি’র জন্মক্ষণ। তারপর মহাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধখাতে বিভিন্ন দেশ কতটা অর্থ জোগাতে পারবে, তার পরিমাপই মুখ্য হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জিডিপি’র হিসাবও।
জনকল্যাণ তো শান্তিপর্বের বিলাসিতা মাত্র! যুদ্ধ অবশ্য শেষ হয় এবং কী আশ্চর্য! জিডিপি’র শিকড় আরও শক্ত হয়। দুনিয়াকে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে জিডিপি। এর অন্যতম প্রধান কারণ এটি এক সহজ সূচক। কেবল একটি সংখ্যাই অর্থনীতির হালহকিকত নির্দেশ করে। এর উল্লেখ সহজ, সহজ বিভিন্ন অর্থব্যবস্থার মধ্যে বা একই অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন সময়ের মধ্যে তুলনাও।
একটি দেশের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাধারণত এক বছরে ভৌগলিক সীমানার মধ্যে দেশি বা বিদেশি নাগরিকদের দ্বারা উৎপাদিত সকল দ্রব্য ও সেবার আর্থিক মূল্যকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বলে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত, অর্থবছরের সংজ্ঞা অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে ৩০ জুনের মধ্যে সম্পাদিত অর্থনৈতিক কাজের হিসাব হলো বাংলাদেশের জিডিপি। এটি মূলত একটি দেশের অর্থনীতির অবস্থার মূল্যায়ন করতে ব্যবহৃত হয়।
কেমব্রিজের অধ্যাপক ডায়ান কোয়েল তাঁর ২০১৬-এর বই জিডিপি: অ্যা ব্রিফ বাট অ্যাফেকশনেট হিস্ট্রিতে বলেছেন, জিডিপি হয়তো বিশ শতকের পক্ষে উপযুক্ত পরিমাপই ছিল, কিন্তু উদ্ভাবন, পরিষেবা এবং অস্পষ্ট পণ্য দ¦ারা নিয়ন্ত্রিত একুশ শতকের অর্থনীতির জন্য তা ক্রমেই হয়ে পড়েছে অনুপযুক্ত।
জিডিপি পরিমাপ ও বোঝার সবচেয়ে সাধারণ উপায় হচ্ছে ব্যয় পদ্ধতি। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন = ভোগ + বিনিয়োগ+(সরকারি ব্যয়) + (রপ্তানি-আমদানি) এই সমীকরণের ভোগ ও বিনিয়োগ হচ্ছে চূড়ান্ত পণ্যের উপর ব্যয়। সমীকরণের রপ্তানি থেকে আমদানি বিয়োগের অংশটি (ক্রম সঞ্চয় রপ্তানি নামেও ডাকা হয়) এরপর এই ব্যয়ের যে অংশটি দেশে উৎপাদিত হয়নি তার সমতা রক্ষা করে। এবার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। দেশের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত সমস্ত পণ্য ও সেবার বাজারমূল্য= ঐ সময়ে দেশের অভ্যন্তরে জনগণের ভোগ করা সমস্ত পণ্য ও সেবার মোট বাজারমূল্য+বিনিয়োগ+সরকারি ব্যয়+রপ্তানিকৃত পণ্যের মোট বাজারমূল্য-আমদানিকৃত পণ্যের মোট বাজারমূল্য।
প্রশ্ন হলো, বিনিয়োগ কেন যোগ হবে? উৎপাদন থেকে যা আয় হয় তার একটা অংশ ভোগের পিছনে ব্যয় হয় বাকিটা সঞ্চয় বা বিনিয়োগ হয়। তাহলে, এখানে সরকারি ব্যয়কে যোগ করা হয় কেন? সরকারি ব্যয় দ্বারা পণ্য বা সেবা ক্রয় করা হয়। ধরা যাক, একজন সরকারি চাকরিজীবী তিনি একটি দপ্তরে যে সেবা দিচ্ছেন (অর্থনীতির ভাষায় যে সেবা উৎপাদন করছেন) জনগণ তা বিনামূল্যে ভোগ করছে। কিন্তু সরকার উক্ত চাকরিজীবী ব্যক্তিকে এই সেবার মূল্য হিসাবে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করছে। এটি সরকারি ব্যয়ের একটি উদাহরণ। আবার সরকারি দপ্তর বা প্রকল্পসমূহে যে সকল দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করা হয় তা কেউ না কেউ উৎপাদন করে। রপ্তানি যোগ করা হয়, কারণ দেশে যা উৎপাদন হয় তার একটা অংশ রপ্তানি করা হয়। আবার আমদানি বাদ দেয়া হয়, কারণ ভোগের একটা অংশ আসে আমদানি থেকে। এই অংশ দেশের অভ্যন্তরে উৎপন্ন হয় না।
তাহলে, জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি কি? বৎসরান্তে কোন দেশের জিডিপি’র আকার যে পরিমাণ বৃদ্ধি পায় তাকে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি বলে। আর এই প্রবৃদ্ধিকে শতকরা হিসাবে প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে বলে প্রবৃদ্ধির হার।
তাহলে কী আজকের জিডিপি আবিষ্ট দুনিয়ায় কোনও দেশের নীতি নির্ধারিত হয় জিডিপিকে টেনে তোলার লক্ষ্যে? কারণ জিডিপিতে সামান্য বদলও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে নির্বাচনে। প্রভাবিত করতে পারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে, নির্দেশ করতে পারে দেশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ নিতে পারবে কি না, বা দেশ মন্দার কবলে পড়ছে কি না। কিন্তু অমিত পরাক্রমশালী এই জিডিপির গঠনশৈলীতেই বিস্তর গলদ। যেমন, ২০১৩-এর মাঝামাঝি আমেরিকা বদলে দিল জিডিপি পরিমাপের পদ্ধতি আর দেশটার জিডিপি এক দিনেই বেড়ে গেল ৩%। ২০১০ এ ঘানা তাদের জিডিপি পারিমাপের তুলনার মাপকাঠিকে ১৯৯৩ থেকে বদলে করল ২০০৬, আর দেশটার জিডিপি একলাফে বেড়ে গেল ৬০%।
১৯৫৯ এ ষ্ট্যানফোর্ডের অর্থনীতিবিদ মোজেস আব্রামোভিজ প্রশ্ন তোলেন জনহিত পরিমাপে জিডিপি-র উপযোগিতা নিয়ে। যদিও ১৯৩৪ এ একই কথা বলেন স্বয়ং কুজনেটস-ই। আসলে জিডিপি যে কেবল জগৎ শেঠদের সম্পদের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত তাই নয়, আমাদের জীবন এবং জীবনযাপনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একেবারে চোখ বুজে থাকে এই অতি গুরুত্বর্পূণ সূচকটি। যেমন পরিবেশ দূষণ, সামাজিক অসাম্য, স্বাস্থ্য-পরিষেবার হাল, সামাজিক অপরাধ, বা যানজট সময়ের অপচয় পর্যন্ত কোনও কিছুতেই নেই প্রায় সর্বশক্তিমান জিডিপি। এমনকি কোভিড-উত্তরকালে বিভিন্ন দেশের অর্থব্যবস্থা যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তখন তাদের অন্তর্নিহিত অসাম্য কতটা প্রকটতর হচ্ছে তারও কোনও হদিস নেই জিডিপি-র সংখ্যার মধ্যে। অবৈতনিক কাজেরও কোনও হিসাব নেয় না জিডিপি। ডায়ান কোয়েল যেমন বলেছেন, গৃহস্থালির কাজকর্মকে অর্থনৈতিক মানদন্ডের নিরিখে যোগ করলে অনেক দেশেরই জিডিপি বেড়ে যাবে ২০% থেকে ৫০% পর্যন্ত।
প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে নারীদের গৃহস্থালির কাজ জিডিপি হিসাবে যোগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর আত্তীকৃত ও অমূল্যায়িত গৃহস্থালি ও সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি না থাকায় কীভাবে এই অবদান হিসাব করা হবে তার পদ্ধতি নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা। যেহেতু আর্থিক মূল্য ছাড়া কোনো কাজই বাজার অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না, তবে বিশে^র অনেক দেশের অর্থনীতিবিদরা সাধারণত স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরুষদের তুলনায় সাড়ে তিন গুণ বেশি মজুরিবিহীন কাজ করেন নারীরা। অন্যদিকে ‘শ্রম জরিপ ২০২২’ এর প্রতিবেদনে কৃষিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অবদান বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে ৪৩% বেশি নারী পুরোপুরিভাবে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০%। তবে নারীর এই গৃহস্থালি কাজকে জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতিতে (এসএনএ) যোগ করা গেলে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়াবে ৪৮% তবে এটা হবে শ্যাডো মূল্যায়ন।
জিডিপি’র পরিপূরক হিসাবে কিংবা তাকে প্রতিস্থাপিত করে অর্থপূর্ণ সূচক তৈরির প্রচেষ্টা তাই চলতে থাকে। আজ অবশ্য জিডিপির বিকল্প হিসাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসেছে নানা সূচক। চিনে ‘‘ গ্রিন জিডিপি’’ নিউজিল্যান্ডের ‘‘লিভিং ষ্ট্যার্ন্ডাডস ফ্রেমওয়ার্ক’’ মেরিল্যান্ড বা ভারমন্টের মতো আমেকিার কয়েকটি প্রদেশে জেনুইন প্রোগ্রেস ইন্ডিকেটর ইত্যাদি। জিডিপির আওতা থেকে বের হওয়ার তাগিদেই। কিন্তু কোনও সূচক আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বজনগ্রাহ্য না হলে বিভিন্ন অর্থ ব্যবস্থার। এমনকি একই অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন সময়ের পরিস্থিতির ও তুলনা অসম্ভব। আর এই তুলনাটাও তো প্রয়োজন নানা কারণে।
বিভিন্ন সময়ে জিডিপি’র বিকল্প খোঁজার চেষ্টা কিন্তু হয়েছে বেশ উচ্চ পর্যায় থেকে। প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি ২০ জনের একটি কমিটি নিয়োগ করলেন, যার নেতৃত্বে নোবেল জয়ী জোসেফ স্টিগলিৎজ, অর্মত্য সেন আর ফরাসি অর্থনীতিবিদ জ্যাঁ-পল-ফিটোসি। কমিটি রিপোর্ট প্রদান করে ২০০৯ সালে। তাদের মতামত, জীবনযাপনের গুণগত মানের পরিমাপ করার সময় যেন অসাম্যকে ঠিকভাবে হিসাবে রাখা হয়। পরে এই কমিটির পরম্পরা ধরেই আর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি নিয়োগ করে ‘‘দি অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট” (ওইসিডি) নেতৃত্বে। দুটি রিপোর্ট ‘‘বিয়ন্ড জিডিপি’’ আর ‘‘ফর গুড মেজারস’’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে।
কোনও দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের মূল্যায়নে অতিরিক্ত জিডিপি নির্ভরতা সরিয়ে তার পরিবর্তে সর্বস্তরে ভালো থাকা এবং সু-স্থায়িত্বকে প্রতিফলিত করবে, এমন একগুচ্ছ সূচক ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে। ২০২১-এ ‘‘আওয়ার কমন অ্যাজেন্ডা’’ শীর্ষক রিপোর্টে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস এরও এক সুর-উন্নতির পরিমাপের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন জিডিপি’র পরিপূরক কোনও সূচক ২০৩০ সালের মধ্যেই।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণ বুঝতে শুরু করলেন , জনগণের ‘‘ভালো থাকা’’ কে মাপতে প্রয়োজনে হুমাত্রিক সূচকের ও সাহায্য নিতে হতে পারে। কিন্তু জিডিপি কে প্রতিস্থাপিত করে সর্বজনগ্রাহ্য এক বা একগুচ্ছ সূচক তৈরির জন্য ঠিক কী কী দেয়া উচিৎ এবং কীভাবে সেই পরিমাপ করা উচিৎ, সে নিয়ে এখনও কোনও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি আন্তর্জাতিক স্তরে। ফলে জিডিপি’র অঙ্কের ওঠাপড়া দেখে উত্তেজিত না হয়ে আমরা বরং ভাবতে পারি, সেটা কার ভাল থাকার গল্প বলছে!
Posted ১:৩১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy