বিবিএনিউজ.নেট | মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৯ | প্রিন্ট | 1093 বার পঠিত
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমাতে বিভিন্ন শ্রেণীর অনাদায়ী ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রোববার জারি করা প্রজ্ঞাপনে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, সন্দেহজনক ও মন্দঋণ শ্রেণীকৃত করার সময় আরো তিন মাস করে বাড়ানো হয়েছে। ৩০ জুন থেকে এ পদ্ধতি কার্যকর হলে কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।
বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণের কিস্তি টানা তিন মাস পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ছয় মাস পরিশোধ না করলে সন্দেহজনক ও নয় মাসের কিস্তি বকেয়া পড়লে মন্দমানের খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকৃত করা হয়। নতুন প্রজ্ঞাপনে শ্রেণীকরণের সময় সবক্ষেত্রেই তিন মাস করে বাড়ানো হয়েছে। দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের কাছে পাঠানো প্রজ্ঞাপনটি চলতি বছরের ৩০ জুন থেকে কার্যকর হবে।
খেলাপি ঋণের নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে লাভবান হবেন ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও শেয়ারহোল্ডাররা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি ঋণকে খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করতে আরো বেশি সময় পাওয়া গেলে আগামী জুলাই থেকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমবে। এতে কমে আসবে সঞ্চিতি সংরক্ষণের চাপও। এছাড়া আগে সংরক্ষণ করা সঞ্চিতির একটি অংশও ব্যাংকের মুনাফায় যোগ হবে। বছর শেষে এ মুনাফা লভ্যাংশ আকারে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টিত হবে। তাতে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট না কমে উল্টো বেড়ে যেতে পারে। ঋণের ঊর্ধ্বমুখী সুদহারের লাগাম টেনে ধরতে এ পদক্ষেপ বিশেষ কাজে আসবে না বলেই ধারণা তাদের।
খেলাপি ঋণ গণনার মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি ঋণের ওপর বছরে চারবারের পরিবর্তে দুবার সুদ আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি মাসের মধ্যেই ঋণে সুদ আরোপের এ নীতিমালা জারি হতে পারে। বিদ্যমান ঋণ পরিশোধ নীতিমালা অনুযায়ী, বছরে চারবার সুদ আরোপ করে ব্যাংক। প্রতি ত্রৈমাসিকে ঋণের ওপর সুদ আরোপ করা হয়। এতে ব্যাংকের সুদ আয় বাড়লেও ভুক্তভোগী হন ঋণগ্রহীতা। এ অবস্থায় গ্রাহকদের বাড়তি সুবিধা দিতে ঋণ পরিশোধের নীতিমালায় পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ত্রৈমাসিকের পরিবর্তে ছয় মাসে একবার অর্থাৎ প্রতি বছরের জুন ও ডিসেম্বরে সুদ আরোপ করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ঋণ পরিশোধের নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে বছরে ব্যাংকগুলোর সুদ আয় ৯৬৩ কোটি টাকা কমবে। ফলে সুফল পাবেন গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতাদের স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের মেয়াদ গণনায় কিছু পরিবর্তন এনেছে। প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলংকা, নেপালের চেয়ে আমাদের ব্যাংকিং খাতে ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা কঠোর ছিল। এখন পরিস্থিতি বিবেচনায় এ নীতিমালায় কিছুটা শিথিলতা আনা হয়েছে। আশা করছি, এর মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমে আসবে।
ঋণে সুদ আরোপের নীতিমালায় পরিবর্তন আনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ঋণের সুদহার কমানোর বিষয়ে অনেক আগে থেকেই আলাপ-আলোচনা চলছে। সরকারও ব্যাংকঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে উদ্যোগ নিয়েছে। এ ধারাবাহিকতায়ই ঋণের ওপর বছরে চারবারের পরিবর্তে দুবার সুদ আরোপের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। আশা করছি, অল্প সময়ের মধ্যেই এ বিষয়ে নির্দেশনা আসবে।
আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০১২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য ঋণ শ্রেণীকরণ ও প্রভিশনিং সংক্রান্ত মাস্টার সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণের কিস্তি নির্ধারিত সময়ের পর টানা তিন মাস পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ছয় মাস পরিশোধ না করলে সন্দেহজনক ও নয় মাস কিস্তি বকেয়া পড়লে মন্দমানের খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়। ব্যাংকিং খাতের জন্য বিশ্বব্যাপী অনুসরণীয় ব্যাসেল-২ ও ৩ বাস্তবায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ওই নীতিমালা জারি করা হয়েছিল। এ নীতিমালা জারির পর থেকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনকৃত স্ট্রেসড বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ এবং অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবায়ন করলে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে। এ অবস্থায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য নীতিমালায় পরিবর্তন আনল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, টানা নয় মাস পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করেও একজন গ্রাহক খেলাপি হবেন না। তিন থেকে সর্বোচ্চ নয় মাসের মধ্যে কোনো গ্রাহক কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড মানে শ্রেণীকরণ করা যাবে। টানা নয় মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সে ঋণের শ্রেণীকরণ হবে সন্দেহজনক। এছাড়া টানা ১২ মাস বা এর বেশি সময়েও কেউ ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেটি হবে মন্দমানের খেলাপি ঋণ।
কন্টিনিউয়াস লোন, ডিমান্ড লোন, ফিক্সড টার্ম লোন বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একই নীতি বাস্তবায়ন হবে। কন্টিনিউয়াস ও ডিমান্ড লোনের ওভারডিউ হওয়ার মেয়াদ গণনা শুরু হবে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার তারিখ থেকে। আর ফিক্সড টার্ম লোন ওভারডিউ হওয়ার মেয়াদ কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থতার তারিখের ছয় মাস পর গণনা শুরু হবে। সে হিসেবে ফিক্সড টার্ম লোনের গ্রাহকরা টানা নয় মাস কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে তবেই ব্যাংক তাকে খেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নিতে পারবে।
ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতিমালায় ফিক্সড টার্ম লোনের গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন বলে মনে করেন ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, নতুন নীতিমালাটি আগামী ৩০ জুন থেকে বাস্তবায়ন হবে। এ নীতিমালার সুযোগ নেয়ার জন্য বর্তমানে নিয়মিত গ্রাহকরাও ঋণের কিস্তি পরিশোধ থেকে বিরত থাকতে পারেন। এটি ঘটলে ব্যাংকের দৈনন্দিন জমার পরিমাণ কমে যাবে, ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরো বাড়বে। ঋণ শ্রেণীকরণের নতুন নীতিমালাটি বাস্তবায়ন হলে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমবে। তবে তাতে বিদ্যমান তারল্য সংকটের কোনো সমাধান হবে না। কারণ খেলাপি ঋণ কমলে ব্যাংকের সঞ্চিতি সংরক্ষণ কমবে। উদ্বৃত্ত সঞ্চিতি ব্যাংকের মুনাফায় যোগ হবে। এতে শেয়ারহোল্ডাররা উপকৃত হলেও তারল্য পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।
ঋণের ওপর বছরে চারবারের পরিবর্তে দুবার সুদ আরোপের নীতিমালা প্রসঙ্গে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এ ধরনের কোনো প্রজ্ঞাপন আমরা এখনো পাইনি। অর্থমন্ত্রী এর আগে ঋণের ওপর সরল সুদ আরোপের বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। নীতিমালা জারি হলে তখন লাভ-ক্ষতির চিন্তা আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, ঋণের ওপর বছরে চারবারের পরিবর্তে দুবার সুদ আরোপের বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি জারি করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। কিন্তু অর্থমন্ত্রী হঠাৎ করে ঋণের ওপর সরল সুদ আরোপের বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। এজন্য ওই নীতিমালা জারির বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
ঋণের ওপর বছরে দুবার সুদ আরোপ করা হলে ব্যাংকের সুদ আয় প্রায় হাজার কোটি টাকা কমে যাবে। এ অবস্থায় নতুন নীতিমালা জারি হলে তফসিলি ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, একটি পক্ষ লাভবান হলে অন্য পক্ষ কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে সব পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে। আশা করছি, নতুন নীতিমালা মানার ক্ষেত্রে তফসিলি ব্যাংকগুলোর সমস্যা হবে না।
Posted ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed