| বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | প্রিন্ট | 489 বার পঠিত
বীমা কোম্পানিগুলোকে অনুমোদন পাওয়ার তিন বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ২৮টি কোম্পানি এই আইন মানছে না। এর মধ্যে কোনো কোনো কোম্পানির বয়স ২০ বছর ছাড়িয়েছে। কিন্তু বাজারে আসতে পারেনি। প্রতিটি কোম্পানিকেই প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হচ্ছে।
শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্ত হলে কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে। তাই এই ব্যাপারে তেমন আগ্রহ নেই কোম্পানিগুলোর। পাশাপাশি অধিকাংশ কোম্পানি লাভজনক নয় বলেও দাবি সংশ্লিষ্টদের।
রোববার বীমা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এক বৈঠকে এসব কোম্পানিকে বাজারে আসার জন্য তিন মাস সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই সময়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত হতে না পারলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেশির ভাগ কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা নেই। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানি দেউলিয়ার পথে। এরপরও যেসব কোম্পানি সর্বশেষ সময়সীমার মধ্যে বাজারে আসতে পারবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ)।
এ প্রসঙ্গে আইডিআরএ’র সদস্য গকুল চাঁদ দাস বলেন, কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স দেয়ার সময় তিন বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে আসার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা সেখানে ব্যর্থ হয়েছে।
এবার অর্থমন্ত্রী নিজেই সময়সীমা বেঁধে দিলেন। এই সময়ের মধ্যে না আসতে পারলে ব্যবস্থা নিতেই হবে। তিনি বলেন, এসব কোম্পানিকে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। বছরে এই টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। তিনি বলেন, এই জরিমানায় কোনো মাফ নেই। এরই মধ্যে এই জরিমানা কয়েকটি কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে। বাকিগুলো থেকেও আদায় করা হবে।
জানা গেছে, সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে বেসরকারি কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য পর পর তিন বছর লাভজনক হতে হয়। কিন্তু ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার কারণে তালিকাভুক্তির বেশির ভাগ কোম্পানিই লোকসানে রয়েছে। এমনকি হাজার হাজার গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না। পাওনা টাকার জন্য প্রতিদিনই গ্রাহকরা আইডিআরএ’র কার্যালয়ে ভিড় করছে।
বর্তমানে বাজারে নতুন ও পুরনো মিলিয়ে ২৮টি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। এর মধ্যে পুরনো ১৩টি এবং নতুন ১৫টি। ১৯৯৬ সালে অনুমোদন পায় হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স। পরিশোধিত মূলধন প্রায় ২০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিকে ৩ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে আসার বাধ্যবাধকতা ছিল। ২৩ বছরের মধ্যেও আসতে পারেনি ওই প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে বড় অঙ্কের জরিমানা আদায় করেছে আইডিআরএ।
এ প্রসঙ্গে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজুল ইসলাম তালুকদার বলেন, শেয়ারবাজারে আসতে না পারার কারণ হল, আমাদের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৩ কোটি টাকা। আর শেয়ারের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ। ২০০৪ সালে কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিক্রি নিয়ে কিছু অনিয়ম করেছেন।
বিষয়টি একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্যেও আমরা বাজারে আসতে পারিনি। তিনি বলেন, এজন্য আমাদের বড় অঙ্কের মূল্য দিতে হচ্ছে। এছাড়া ২০০০ সালে অনুমোদন পায় বায়রা লাইফ। ১৯ বছরেও পুঁজিবাজারে আসতে পারেনি এ প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে ৮ হাজার গ্রাহকের টাকা দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। একই অবস্থা বিকল্প ধারা বাংলাদেশের নেতা মেজর (অব.) মান্নানের মালিকানাধীন সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের। এই কোম্পানিও দেউলিয়ার কাছাকাছি। এ ছাড়াও পুরনো যেসব কোম্পানি এই বাধ্যবাধকতা পালনে ব্যর্থ হয়েছে, এগুলো হল- গোল্ডেন লাইফ, মেঘনা ইন্স্যুরেন্স, ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স এবং এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স।
অন্যদিকে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ১৫টি বীমা কোম্পানির লাইসেন্স দেয় আইডিআরএ। বাজারে চাহিদা উপেক্ষা করে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় দেয়া হয় এসব কোম্পানির লাইসেন্স। এর সব কোম্পানির সঙ্গে ক্ষমতাসীন বড় বড় রাজনীতিকের সম্পর্ক রয়েছে। তবে অনুমোদনের পর তিন বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে আসার শর্তটি লিখিতভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এক্ষেত্রে জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন ছিল ১৮ কোটি টাকা। বাকি ১২ কোটি শেয়ারবাজার থেকে সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল। সে হিসাবে ২০১৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যে শেয়ারবাজারে আসার সময়সীমা শেষ হয়েছে। তবে তিন বছর শেষ হওয়ার পর কয়েকটি কোম্পানি আরও ২ বছর সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। এই সময় শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু তারা এ পর্যন্ত আসতে পারেনি।
এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- আলফা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বেস্ট লাইফ, চাটার্ড লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, গার্ডিয়ান লাইফ, যমুনা লাইফ, এনআরবি গ্লোবাল লাইফ, প্রটেকটিভ লাইফ, সোনালী লাইফ, স্বদেশ লাইফ, ট্রাস্ট লাইফ এবং জেনিথ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। নতুন অনুমোদন পাওয়া সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ইন্স্যুরেন্স, সিকদার ইন্স্যুরেন্স এবং সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে আসতে হলে প্রতিষ্ঠানকে পর পর তিন বছর লাভজনক হতে হয়। কিন্তু কোনো কোম্পানিই মুনাফায় আসতে পারেনি। বেশ কয়েকটি কোম্পানি লাইফ ফান্ডের টাকা ভেঙে খরচ মেটাচ্ছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা দিতে হচ্ছে। তবে দু-একটি কোম্পানি বাজারে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এ ব্যাপারে জেনিথ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম নুরুজ্জামান বলেন, আমাদের কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আইপিওর (প্রাথমিক শেয়ার) জন্য আমরা প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটালের সঙ্গে চুক্তি করেছি।
এ প্রসঙ্গে বীমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন থেকে কোম্পানিগুলো আসছে না। এর বড় কারণ হলো উদ্যোগের অভাব এবং অনীহা।
এ ছাড়াও নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে বড় কোনো চাপ নেই। ফলে এ সময়ে উদ্যোগ নিতে আমরা আইডিআরএকে বলব। তিনি বলেন, মালিক পক্ষের চেয়েও এ ব্যাপারে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের উদ্যোগ নেয়া উচিত। এমডিরা বোর্ডকে বোঝাবেন, বাজারে না এলে প্রতিদিন তাদের ৫ হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। এভাবে বছরে বড় অঙ্কের লোকসান হয় কোম্পানিগুলোর। আশা করছি, তারা উদ্যোগ নেবেন।
২০১০ সালের বীমা আইন অনুসারে সাধারণ বীমা কোম্পানির সর্বনিম্ন পরিশোধিত মূলধন হবে ৪০ কোটি টাকা। আর জীবন বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রে এই সীমা ৩০ কোটি টাকা। এখনও প্রায় ১৫টি কোম্পানি ন্যূনতম মূলধন পূরণ করতে পারেনি। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, বীমা কোম্পানিগুলোর পরিশোধিত মূলধন ১০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে যা বীমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্যে প্রভাব ফেলেছে।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আইন লঙ্ঘনকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনেও কোম্পানিগুলোকে বাজারে আসতে না পারলে এটা তাদের ব্যর্থতা। এজন্য আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে। মির্জ্জা আজিজ বলেন, বাজারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান আইনগুলো সঠিকভাবে পালন হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।
আইডিআরএ সূত্র জানায়, দেশের ৭৮টি বীমা কোম্পানির মধ্যে জীবন বীমা ৩১টি এবং সাধারণ বীমা ৪৮টি। দুই খাত মিলিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৪৭টি। দেশের অর্থনীতির আকার অনুসারে কোম্পানি অনেক।
এরপরও দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বীমা খাতের অবদান ১ শতাংশেরও কম। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো- কোম্পানিগুলোর সীমাহীন প্রতারণায় বিশাল এই খাতের প্রতি মানুষের অনাস্থা। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশকিছু বীমা কোম্পানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব কোম্পানির পেছনে বড় মাপের রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদ রয়েছে। ফলে এরা কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করছে না।
২০১০ সালে নতুন বীমা আইন হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও এখনও ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি আশার দিকও কম নয়। দেড় বছরে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র উদ্যোগে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
Posted ১:১২ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed