নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট | 851 বার পঠিত
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের পর সাবেক কমিটির ব্যাপক আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা একের পর এক বেরিয়ে আসছে। নতুন নিয়োগ পাওয়া এই কমিটির সদস্যদের অন্যতম দায়িত্ব হলো কোম্পানির বিগত ১০ বছরের সকল আর্থিক অনিয়ম খুঁজে বের করে তা কমিশনে দাখিল করা ও পরামর্শ প্রদান। গত ৬ সেপ্টেম্বর ২৫৬তম বোর্ড সভা করার মাধ্যমে নতুন এই পর্ষদের কার্যক্রম শুরু হয়।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিশেষ নিরীক্ষায় বেড়িয়ে আসে যে ফারইষ্টের পর্ষদ ভেঙে দেয়ার আগেই প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। অর্থ আত্মসাতের এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান এম এ খালেকের বড় পরিসরে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে তিনি নিজে, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নামে বেনামে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য থাকাকালে এসব অনিয়ম সংঘটিত করেন।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত সাবেক চেয়ারম্যান এম এ খালেকের সাথে টেলিফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে যোগযোগের কারণ জানিয়ে ক্ষুদে বাতা পাঠানো হলেও তিনি তার কোন প্রতিউত্তর দেননি।
অনুসন্ধান চলাকালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেনের সংশ্লিষ্টতাও এতে উঠে আসে। কেননা ড. মোশাররফ ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফারইস্ট ইসলামী লাইফের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে অডিট কমিটির প্রধান ছিলেন। ফলে এসব অনিয়মে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে আইডিআরএর চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন- ‘তৎকালীন সময়ে পরিচালনা পর্ষদকে এ বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হলেও তারা কর্ণপাত করার মতো লোক ছিলেন না। যখনই আমি এ বিষয়ে কঠিনভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছি তখনই আমাকে পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।’
তিনি দাবী করেন যে তিনি যখন প্রতিষ্ঠানটির সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তখন ফারইস্ট লাইফে একটি অনিয়মও সংঘটিত হতে দেননি। এমনকি দেশের বীমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ফারইস্ট ছিলো সবার শীর্ষে। বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে বিএসইসি’র পদক্ষেপ নেয়ায় আইডিআরএ’র ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন বলেন- ‘আমরা মূলত আরো অধিকতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলাম। আমাদের কার্যক্রম এখনও চলমান।’ কিন্তু আইডিআরএ’র একটি প্রতিবেদনে ফারইস্ট চেয়ারম্যানকে দায় মুক্তি দেয়া হয়েছে এমনটা জানালে তিনি বলেন- ‘সে সময় নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম এই দায়িত্ব পরিপালন করেছেন। তাই তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’ পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পর এখন আর কী ব্যবস্থা নিতে পারেন এমন প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘অধিক তদন্তে অনিয়ম প্রমানিত হলে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল বা অন্য কোন কোম্পানির সাথে একীভূত করার ব্যবস্থা হতে পারে।’
দায়মুক্তির ব্যাপারে রেজাউল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা তদন্ত করতে গিয়ে সাবেক পরিচালক এম এ খালেকের ব্যাপক দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছি। অন্যদের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে তথ্য উপাত্ত না পাওয়ায় তাদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
এই দায়মুক্তি দেয়া কালে কোম্পানির তৎকালীন অডিট কমিটির প্রধানকে (বর্তমান আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেন) জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছিল কিনা, এমনটা জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় সম্প্রতি এর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আগের কমিটির পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
নতুন পর্ষদের দায়িত্ব হলো আগামী ৬ মাসের মধ্যে কোম্পানি শীর্ষ ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন, করপোরেট ক্যাশ ও সম্পদ ফিরিয়ে আনা এবং যারা গত ১০ বছরে ফারইস্ট লাইফে আর্থিক অপরাধ ও মানি লন্ডারিং করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া।
ফারইষ্ট থেকে যে ১ হাজার ১৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের এমপ্লয়ি কো-অপারেটিভ সোসাইটির নামে ১২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা, প্রাইম ইসলামী লাইফে অগ্রীম বাবদ প্রদানের নামে ৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, ব্যাংক এফডিআর লিয়েন করে ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা, পিইএল সিকিউরিটিজের নামে ৭০ কোটি ২১ লাখ টাকা, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ১০৫ কোটি টাকা, প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ২৩ কোটি টাকা, পিএলআই প্রোপার্টিজ নামে ৯৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা, মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ১০ কোটি ৪১ লাখ টাকা, কে এম খালেদের নামে ১৭ কোটি ১১ লাখ টাকা, আজাদ অটোমোবাইল নামে ৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা, মিথিলা প্রোপার্টিজ নামে ৪৮ কোটি ১২ লাখ টাকা, এম এ খালেক নিজ নামে ৭৩ কোটি টাকা, ম্যাকসন্স অ্যাসোসিয়েট নামে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা, প্রাইম প্রোপার্টি হোল্ডিংস নামে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা এবং মিজানুর রহমান নামে ৮৪ লাখ টাকা।
এক্ষেত্রে অর্থ হাতানোর এ বিষয়টি সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন- ২০১২ এর উপ-ধারা 2(z)(i) এবং2(cc) আওতায় পড়ে। তবে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ রিপোর্টিং এজেন্সি হিসেবে বিষয়টি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে জানানো নির্দেশনা থাকলেও সেটা তারা করেনি।
এসব বিষয়ে ব্যাংক বীমা অর্থনীতি নিজস্ব অনুসন্ধান চালাতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের বিগত বছরগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদনের জন্য শেয়ার বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সেখান থেকে কোম্পানির সিইও হেমায়েত উল্লাহ’র সাথে কথা বলার পরামর্শ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ওই মুখ্য নির্বাহীকে ফোন করা হলে তিনি জানান, কোম্পানির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ বার্ষিক প্রতিবেদন কাউকে প্রদান না করার বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে। তবে এমন নির্দেশনার স্বপক্ষে কোন কাগজ দেখাতে তিনি ব্যর্থ হন। এছাড়া গত ৬ সেপ্টেম্বর আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে বিকাল সাড়ে ৩ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত রূদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে কিনা এ সম্পকে১ জানতে চাইলে তিনি এ নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। তবে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের সাথে আলাপকালে বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে বীমাখাতে তুমুল সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
Posted ১১:৪১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy