নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ২১ নভেম্বর ২০২১ | প্রিন্ট | 448 বার পঠিত
দেশের নন-লাইফ বীমাখাতে পুনঃবীমার ক্ষেত্রে নতুন শর্তারোপ করেছে দেশের একমাত্র পুনঃবীমাকারী সংস্থা সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি)। বীমাখাতের উন্নয়নে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির এমন পদক্ষেপ জানানো হলেও একে বিধিবহির্ভূত ও নজিরবিহীন উল্লেখ করেছে বীমাকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। সংগঠনটি বলছে বীমা দাবি নিশ্চিত করতে এসবিসি যে চিঠি দিয়েছে তা বীমা আইন ও নীতিবিরুদ্ধ। বীমাখাতে একমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইডিআরএ) এ ধরনের চিঠি ও সার্কুলার ইস্যু করতে পারে। এ ঘটনায় এসবিসিকে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে চেষ্টা করছে কেউ, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর রি-ইন্স্যুরেন্স করার ক্ষেত্রে বিশেষ শর্তারোপ (ক্লেইম ক্লজ) অন্তর্ভুক্ত করে সকল সাধারণ বীমার কোম্পানিতে প্রেরণ করে এসবিসি। এটি হলো কোম্পানি থেকে গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ সম্পর্কিত তথ্য, যা আইন অনুযায়ী একমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র এখতিয়াভুক্ত।
চিঠিতে বলা হয়, দেশের বীমাবাজারের তথ্যানুযায়ী কয়েকটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি আর্থিক সমস্যায় গ্রাহকদের দাবি নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ছাড়া কিছু বীমা কোম্পানি এসবিসি থেকে পুনঃবীমার পুরো টাকা পাওয়ার পরও গ্রাহকদের দাবি বিলম্বে এবং ধাপে ধাপে নিষ্পত্তি করছে। কয়েকটি কোম্পানির এমন অপকর্ম সার্বিক বীমাখাতের উপর খারাপ ধারণা তৈরি করছে, যা দুঃখজনক। এই অভ্যাস শুধু ক্ষতিপূরণ নীতির লঙ্ঘনই নয়, বরং গ্রাহকের আর্থিক প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় এটি বীমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। যেহেতু এসবিসি পুনঃবীমার প্রধান সুবিধাভোগী, তাই গ্রাহকের দাবি সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করাও প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব।
এতে আরো বলা হয়, মূলত বীমাখাতের সার্বিক উন্নয়নে বিশেষ করে গ্রাহকের স্বার্থরক্ষায় এসবিসির পরিচালনা পর্ষদ এ ধরনের অনৈতিক চর্চাকে নিরুৎসাহিত ও বন্ধ করতে এই সিদ্ধান্ত নেয়। ভবিষ্যতে নতুন ও পুনঃবীমার সকল চুক্তি একটি বিশেষ শর্তসাপেক্ষ হবে। এখন থেকে এসবিসি প্রতিটি ক্ষেত্রে কোম্পানির কাছে দাবিদারের পত্র চাইবে, যেখানে তারা জানাবেন যে দাবির টাকা সম্পূর্ণ পেয়েছেন।
এছাড়া বিশেষ শর্তের দাবি ধারায় (ক্লেইম ক্লজ) বলা হয়, পুনঃবীমার মাধ্যমে দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে গ্রাহকের পক্ষ থেকে এসবিসিতে চিঠি পাঠাতে হবে। এই পত্রে উল্লেখ থাকবে যে, গ্রাহক তার দাবির টাকা সম্পূর্ণ পেয়েছেন। পুনঃবীমা অর্থপ্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে ডিসচার্জ রসিদসহ এটি চিঠি এসবিসিতে জমা দিতে হবে। কোন কারণে বীমাকারী এই শর্ত মেনে চলতে ব্যর্থ হলে দেশের বিদ্যমান বীমা আইন, বিধি ও প্রবিধান অনুযায়ী এসবিসি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে বলে এতে জানানো হয়।
তবে এসবিসির পক্ষ থেকে কোম্পানিগুলোতে পাঠানো এই চিঠিকে বিধিবহির্ভূত ও নজিরবিহীন উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বীমাকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। গত ২৮ অক্টোবর এসবিসি চেয়ারম্যানের প্রতি পাঠানো বিআইএ প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বিশেষ শর্তের চিঠির বিষয়ে বিভিন্ন কোম্পানির পক্ষ থেকে বিআইএ প্রেসিডেন্টকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে বিআইএ প্রেসিডেন্টের এই চিঠি।
মূলত বীমা ও পুনঃবীমা দুটি পৃথক চুক্তি। পুনঃবীমা হয় বীমা কোম্পানি ও পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে। বীমাগ্রাহকের সাথে পুনঃবীমাকারীর সম্পর্ক নেই। তাই গ্রাহকের স্বার্থরক্ষার কথা বলে বীমা কোম্পানির পুনঃবীমার উপর এসবিসির শর্তারোপের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ বলেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। কেননা বীমা আইন অনুযায়ী গ্রাহক যদি তার দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ না পায়, তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগসহ দেশের প্রচলিত আইনে সালিস বা মধ্যস্থতাসহ যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এটি এসবিসির এখতিয়ারভুক্ত কোনো বিষয় না। বীমাদাবি পরিশোধে এসবিসি থেকে সকল বীমা কোম্পানির প্রতি যে দোষারোপ করা হয়েছে নীতিবিরুদ্ধ। তাছাড়া পুনঃবীমাকারী হিসেবে এসবিসি ও নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক অংশীদার হওয়ায় এটি বীমা ও পুনঃবীমা চুক্তির মূলভিত্তি ‘চৎরহপরঢ়ষব ড়ভ ঙঁঃসড়ঃং মড়ড়ফ ভধরঃয’-এর পরিপন্থী। সেক্ষেত্রে এই ধরনের চিঠি ব্যবসায়িক অংশীদারদের সাথে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক ক্ষুণ্ন করবে বলেও এতে জানানো হয়।
একইসাথে এসবিসির এমন চিঠির বিষয়ে বীমাখাতের বিরক্তিভাবও চিঠিতে ফুটে ওঠে। বিশেষ শর্তকে নজিরবিহীন জানিয়ে বলা এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোনো বিদেশি পুনঃবীমাকারী প্রতিষ্ঠান আজ পর্যন্ত এমন কোনো শর্তারোপ করেনি। তাই পেশাদার পুনঃবীমাকারী হিসেবে এসবিসি কর্তৃক পুনঃবীমার চুক্তি শর্তাবলী স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক পুনঃবীমাকারীদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। এ ছাড়া এ ধরনের একতরফা শর্তারোপ হলে তা নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো একত্রিতভাবে বাধ্যতামূলক পুনঃবীমা হার কমিয়ে দেয়াসহ বাতিল করার জন্যও সরকারের কাছে প্রস্তাব করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। বরং এসবিসির প্রতি বিআইএ থেকে পরামর্শ দেয়া হয়, বীমা সেক্টরের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে প্রস্তাবিত বিশেষ শর্ত পুনঃবীমা চুক্তির শর্তে যুক্ত না করে এসবিসি যেন বিদেশি স্বনামধন্য পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠানের মতো দ্রুত ক্লেইম রিকভার প্রদানের মাধ্যমে পেশাদারিত্ব বজায় রাখে।
প্রকৃতপক্ষে গত ৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ বীমা করপোরেশনের ৬৩৪তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় সদ্য যোগদান করা এক সদস্য খসড়া অনুলিপিসহ বিষয়টি উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৪ সেপ্টেম্বর এসবিসির ৬৩৫তম সভায় সে সময় পর্যন্ত এই বিষয়ে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ না নেয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান ওই পরিচালক। এমন পরিস্থিতিতে আরেক পরিচালক সাইফুল্লাহ পান্না ওই পরিচালকের সাথে সহমত জানালে পরিচালক ফৌজিয়া হক তাতে সমর্থন দেন। এরপরই বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য পরিচালনা পর্ষদ থেকে এসবিসির ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
মূলত ওই পরিচালকের ব্যক্তিস্বার্থে এমন শর্ত অন্তর্ভুক্ত ও ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টি করে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক পরিচালকই বিষয়টি ধরতে না পেরে তাতে সম্মতি দেয়। ফলে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা আইডিআরএ’র সমকক্ষ হিসেবে এসবিসিকে দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় তারা ওই পরিচালকের ফাঁদে পড়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টসূত্র। জানা যায়, ওই পরিচালকের নিজস্ব কনসালটেন্সি ফার্ম রয়েছে। এখান থেকে বিভিন্ন সময়ে দাবির টাকা পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে গ্রাহকদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা গ্রহণ করেন। কিছুদিন পূর্বে নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডের সেজান জুস কারখানায় সদলবলে সার্ভেও করতে যান ওই পরিচালক। অথচ তিনি সার্ভে করার অনুমতিপ্রাপ্ত কোনো সদস্য ছিলেন না। এছাড়া জানা যায়, সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহক নান্নু স্পিনিংকে দাবির টাকা পাইয়ে দিতে সাধারণ বীমার পথ বাতলে দেন ওই পরিচালক। দায়িত্বপালনকালে নিজস্বার্থে এই ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালক পদের অপব্যবহার ও অনৈতিক বলে জানান বীমাসংশ্লিষ্টরা।
Posted ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২১ নভেম্বর ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy