
রজত রায় | রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 197 বার পঠিত
বিশ্ব অর্থনীতির ভঙ্গুর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। ফলে ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ছে ক্রেতাদের। দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন ‘‘শূন্য কভিড নীতি’’ শিথিল করার পর বিশ্ব অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা হতে দেখা যাচ্ছে।
বিশ্বে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও অর্থনীতির গতিচাঞ্চল্য দেখা গেছে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গত কয়েক বছর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির পরিমাণ অনেক বেড়েছে এবং সার্বিকভাবে একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। ফলে পশ্চিমা ভোক্তারা তাদের ব্যক্তিগত খরচের ক্ষেত্রে আরও হিসেবি হয়ে উঠেছিলেন। ২০২২ সালের পর শুধু ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভূত হয়। এর পেছনে মূল কারণ ছিল নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, জ¦ালানি সংকট ও সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা।
মূল্যস্ফীতি হল একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দাম বৃদ্ধির হার। মুদ্রাস্ফীতি সাধারণত একটি বিস্তৃত পরিমাপ, যেমন দামের সামগ্রিক বৃদ্ধি বা একটি দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি। তবে এটি আরও সংকীর্ণভাবে গণনা করা যেতে পারে। উদারহরণস্বরপ- কিছু পণ্যের জন্য যেমন খাবার বা পরিষেবাগুলির জন্য। প্রেক্ষাপট যাই হোক না কেন, মুদ্রাস্ফীতি প্রতিনিধিত্ব করে যে পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর প্রাসঙ্গিক সেটা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতবেশি ব্যয়বহুল হয়েছে, সাধারণত এক বছরে।
আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রকাশিত একটি নতুন প্রতিবেদনে দেখা গেছে মুদ্রাস্ফীতির কামড়ের কারণে বিশ্বব্যাপী মজুরি বৃদ্ধি তলিয়ে গেছে। বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি সংকটের কারণে ক্ষীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অনিশ্চয়তার মেঘে ঢাকা দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বজুড়ে প্রকৃত মজুরি হ্রাসের দিকে পরিচালিত করেছে। সদ্য শেষ হওয়া নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর শঙ্কার জায়গায় পৌঁছে গেছে খাদ্য মূূল্যস্ফীতি ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতার মুখ দেখলেও বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশের অর্থ হলো ২০২৩ সালের নভেম্বরে যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতে হয়েছিল ২০২৪ সালের নভেম্বরে তা কিনতে হয়েছে ১১৩ টাকা ৩৮ পয়সায়। একইভাবে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি সংজ্ঞায়িত হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত নভেম্বর ২০২৪ মাসের ভোক্তা মূল্য সূচকে (সিপিআই) এসব তথ্য উঠে এসেছে।
একসময় সবচেয়ে বড় মূল্যস্ফীতির ঘটনা দেখা গেছে আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে। সেখানে আয়ের চেয়ে সরকারের ব্যয় বেশি হলে সরকার অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্ঠা করে। ফলে বাজারে পণ্যের চেয়ে টাকার যোগান বেশি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছিল ৩৭০০ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল প্রায় ১৯০০০ শতাংশ। একই রকম চিত্র দেখা গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে। ১৯২২ থেকে ১৯২৩ সালে জার্মানিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছিল ৩২২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে এমন উদাহরণ হিসেবে এক্ষেত্রে তুলে ধরা যায় শ্রীলঙ্কার নাম। বছর দুয়েক আগে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়লেও সেখান থেকে উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের সংকটকালে দেশটির মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৪৯ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে এই হার এসে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যেসব দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বল, বাজারে নজরদারি কম, সেখানে মূল্যস্ফীতি প্রবল হয়ে ওঠে। বাজারে পণ্যের মজুদ এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায় অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায় তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি থাকলে সেটাকে ‘‘সহনীয়’’ বলা যায়। ৭ থেকে ১০ শতাংশ হলে মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট হয়।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাড়াঁতে শুরু করবে। তাহলে শ্রীলঙ্কা কি পদক্ষেপ নিয়েছে? অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে মুদ্রানীতি কঠোর করে ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়েছে। সরকার কৃচ্ছতা সাধন করে বাজেট ঘাটতি কমিয়েছে, বার্ষিক ঘাটতি কমাতে ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আরও বাড়িয়েছে, ঋণ পুনর্গঠন করেছে। শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোনো কোনো খাতে কর বাড়ানো আবার কোনো খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো অজনপ্রিয় পদক্ষেপও নিয়েছে দেশটি। একই সাথে জ¦ালানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যপণ্যের দাম কম রাখার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে ধাপে ধাপে নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশটির মূল্যস্ফীতি নভেম্বর ২০২৪ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ২ দশমিক ১ শতাংশ।
মানুষের আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী নভেম্বর মাসে জাতীয় মজুরির হার ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মানে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি। বিবিএস গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ১৪৫ টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর হিসাব করে থাকে। মজুরি নির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে। বিবিএস এর তথ্য মোতাবেক দেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে এ রকম কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি।
২০২২-২০২৩ গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বব্যাপী বাস্তব মাসিক মজুরি এই বছর গড়ে শূন্য দশমিক নয় শতাংশ কমেছে, যা একুশ শতকে বিশ্বব্যাপী প্রকৃত আয়ের প্রথম পতনকে চিহ্নিত করেছে। আইএলও মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ হাউংবো এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমরা যে একাধিক বৈশ্বিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছি তা প্রকৃত মজুরি হ্রাসের দিকে পরিচালিত করেছে। এটি কয়েক মিলিয়ন শ্রমিককে একটি ভয়ানক পরিস্থিতিতে ফেলেছে কারণ তারা ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয়েছে। সর্বনিম্ন বেতনের ক্রয়ক্ষমতা বজায় না থাকলে আয় বৈষম্য এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু নিম্ন মজুরি উপার্জনকারীরা তাদের নিষ্পত্তিযোগ্য আয়ের একটি বড় অংশ অপরিহার্য পণ্য এবং পরিষেবাগুলিতে ব্যয় করে, যা সাধারণত অপ্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর তুলনায় বেশি দাম বৃদ্ধি পায়, যারা এটির সামর্থ্য কম রাখে তারা ক্রমবর্ধমান দামের সবচেয়ে বড় ব্যয় জীবনের প্রভাব ভোগ করে।
পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে এখন অনুকুল পরিবেশ। সর্বশেষ নভেম্বরের রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাকের রপ্তানিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ফলস্বরূপ ইতিমধ্যে কয়েকবার নীতি সুদহারও বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু, যেসব দেশের আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি, তারা সহজে এটা সামাল দিতে পারে। কিন্তু যেসব দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বল, বাজারে নজরদারি কম, সেখানে মূল্যস্ফীতি প্রবল হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে? বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশে একেক রকম মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। অনেক উন্নত দেশে মূল্যস্ফীতির হার সামান্যই পরিবর্তন হয়ে থাকে। অনেক সময় মৃদু মূল্যস্ফীতি হয়, অনেক সময় অতি মূল্যস্ফীতি। যখন জিনিসপত্রের দাম আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, মানুষ তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটা মৃদু মূল্যস্ফীতি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম রাতারাতি বেড়ে গেলে তাকে অতি মূল্যস্ফীতি বলা হয়। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমতির দিকে রয়েছে, তবুও গত দুই বছরের পর্যালোচনায় দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে তার সুফল বাংলাদেশ পায় না। দেখা যাচ্ছে গত দু বছরে জ¦ালানি তেল, গ্যাস, কয়লা, লৌহ জাত পণ্যের দাম অনেক কমলেও বাংলাদেশে মুল্যস্ফীতি বেড়েছে। এটার কারণ কি? এর কারণ আমাদের বিনিময় হারও হতে পারে। গত এক দুই মাস ধরে বিনিময় হার স্থিতিশীল আছে, মুদ্রানীতিও মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক। অভ্যন্তরীণভাবে যদি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকে এবং সরকারের ব্যয়ের কৃচ্ছতাও সচল থাকে ও পাশাপাশি বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলোর আমদানি বাজারে মূল্যস্ফীতি কমে তাহলে আমাদের আমদানি পণ্যের দাম কমবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেইল: pkroyrajat2016@gmail.com
Posted ৫:১৭ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy