
রজত রায় | সোমবার, ০৩ মার্চ ২০২৫ | প্রিন্ট | 224 বার পঠিত
মুদ্রানীতি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য গৃহীত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকৌশল। মুদ্রানীতি অর্থনীতিতে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ, সুদের হার নির্ধারণ এবং ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং রিজার্ভ বাড়ানোকে প্রথম চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে দ্বিতীয়ার্ধ জানুয়ারি-জুনের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এটা অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো মুদ্রানীতি। এবারের মুদ্রানীতিতে পলিসি রেট বা নীতি সুদহার বাড়েনি। তাই মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদ্যমান নীতি সুদহার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। সুদের হার অপরিবর্তিত রাখা হলে ঋণের খরচও বাজারের অর্থনৈতিক প্রবাহে একটি স্থিতিশীলতা থাকে।
নীতিসুদ হার কি? নীতিসুদ হার হলো সেই সুদের হার যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার জন্য নির্ধারণ করে। এটি মুদ্রানীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা প্রভাবিত করে। নীতি সুদহারের পাশাপাশি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বিশেষ রেপো বা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) উর্ধ্বসীমা ও সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা রিভার্স রেপো বা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ)। বর্তমানে এসএলএফ ও এসডিএফের সুদহার যথাক্রমে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে নীতি সুদহারের করিডোর রাখা হয়েছে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট। তারল্যের প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের উদ্ধৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে রেপো রেটকে নীতি সুদহার নামে অভিহিত করা হয়। এটি ব্যাংকগুলোর জন্য একটি নির্দেশক হার হিসেবে কাজ করে, যা সরাসরি ঋণের সুদের হার, আমানত সুদের হার এবং বাজারে অর্থের সরবরাহের হার নির্ধারণে সহায়তা করে। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি নীতিসুদ হার স্থিতিশীল রাখতে পারে তাহলে এর মাধ্যমে অর্থনীতির সুস্থতা ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
মুদ্রানীতি এটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, মূল্যস্ফীতি , বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরাসরি প্রভাব ফেলে, মুদ্রানীতি পরিচালনায় নীতিসুদ হার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এখন দেখা যাক, নীতিসুদ হার কিভাবে কাজ করে? বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদের হার অপরিবর্তিত রাখে, তখন এটি দেশের অর্থনীতির উপর বিভিন্ন ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। নীতিসুদ হার অপরিবর্তিত থাকলে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নির্ধারিত পরিবেশ তৈরি করতে পারে। যখন সুদের হার অপরিবর্তিত থাকে, তখন এটি ব্যবসা এবং শিল্প খাতে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহ প্রদান করে। কম সুদের হার বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ গ্রহণ করা সম্ভব করে তোলে। এতে করে নতুন ব্যবসা শুরু করা, উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। তাহলে, নীতিসুদ হার বাড়লে কি হয়? যদি নীতিসুদ হার বৃদ্ধি পায়, তবে ঋণের খরচ বেড়ে যায় এবং বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে কম আগ্রহী হয়। ফলে নীতিসুদ হার অপরিবর্তিত রাখা ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য সহায়ক হতে পারে।
নীতিসুদ হার ঠিক রাখায় বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে অর্থের সরবরাহের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সুদের হার অপরিবর্তিত হওয়ায় বাজারে দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। যদি সুদের হার খুব বেশি কমানো হয়, তখন অতিরিক্ত ঋণের জন্য চাহিদা বাড়তে পারে এবং এই ঋণের অতিরিক্ত সরবরাহ বাজারে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম ছয় মাসে অর্থনীতিতে বড় কোনো স্বস্তি ফেরানো গেছে, তেমন নয়। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধারাবাহিক যে অবনতি হচ্ছিল তা ঠেকানো গেছে। আর তাই অর্থপাচারের বিরুদ্ধে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রেখে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমাদের রপ্তানি খাতেও বেশ ভালো প্রভাব ফেলবে এই মুদ্রানীতি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে সুদের হার অপরিবর্তিত রাখা রপ্তানিকারকদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে । কম সুদের হার রপ্তানিকারকদের ঋণ নেয়ার খরচ কমায় যা তাদের পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর ফলে দেশের রপ্তানি খাতের বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে এবং বৈদেশিক মুদ্রার উদ্ধৃত্ত বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়।
বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের জন্য সুদের হার অপরিবর্তিত রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন সুদের হার অপরিবর্তিত থাকে, তখন ব্যাংকগুলো সহজেই ঋণ দিতে পারে এবং ঋণ গ্রহণকারীরা ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারে। এতে করে ঋণ গ্রহণকারীদের মাধ্যমে ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং ব্যাংকগুলোর আয় ও বাড়ে। তবে ব্যাংকগুলোর সুদের হার বৃদ্ধির ফলে মানুষের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমে যেতে পারে, যা ব্যাংকিং খাতের আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দেশের বেদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দীর্ঘদিন ধরে ২০ বিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল আছে। বর্তমানে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে। ডলারের দরও ১২২ থেকে ১২৪ টাকায় স্থিতিশীল আছে। গত জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমেছে। ২০২৪ এ ডিসেম্বর শেষে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। যা সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।
মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের জন্য একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। এই মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়ক হবে। যেহেতু সুদের হার বৃদ্ধি পেলে ঋণের খরচ বৃদ্ধি পায় এবং এতে চাহিদা কমে, তাই এই মুদ্রানীতি বিনিয়োগকারীদের জন্য ঋণ গ্রহণের খরচ কমিয়ে রাখতে এবং বাজারে অর্থের সরবরাহ কিছুটা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে। এটা ঠিক যে দীর্ঘমেয়াদী যদি সুদের হার অপরিবর্তিত থাকে তাহলে ব্যবসায়ীরা আস্থা রাখে এবং বিনিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে যায়, যা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছর বিনিয়োগ বৃদ্ধির বছর নয়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো যায় কিভাবে সেটাই মুদ্রানীতির প্রধান টার্গেট। নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের মতো রাখা হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। আগামী জুন পর্যন্ত বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
মুদ্রার মান ও বৈদেশিক বিনিয়োগে স্থিতিশীল রাখতে কাজ করে। এর মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের মুদ্রার মূল্যমানকে স্থিতিশীল মনে করে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হতে পারে। সুদের হার পরিবর্তন না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশটি স্থিতিশীল বার্তা দিবে যা দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা করতে সাহায্য করবে। এদিকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাত থেকে সরকারকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশে সুদের হার বাড়ালে যে মূল্যস্ফীতি কমে না এটা ঠিক কিন্তু কারণটা কি? বাংলাদেশ ও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের পরিস্থিতি এক নয়। ওই দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক নির্ভর নয়। এজন্য সুদের হার বাড়ালে বাণিজ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাংক ছাড়া কোন উদ্যোক্তা কোনো মার্কেটেই কাজ করতে পারে না। যে কারণে সুদের হার বাড়লে বাণিজ্যের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। আর এ প্রভাব পরবর্তীতে এসে বাজারের ওপর পড়ে। ফলে পণ্যমূল্যের দাম বাড়ে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়।
এই মুদ্রানীতি দেশের অর্থনীতি আরো স্থিতিশীল করবে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরিস্থিতি অনুযায়ী ধারাবাহিক মনিটরিং ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেইল : pkroyrajat2016@gmail.com
Posted ৩:৫৪ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০৩ মার্চ ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy