বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x

আয়-ব্যয়ের অনিশ্চিত যুদ্ধে অবতীর্ণ নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা

পান্না কুমার রায় রজত   |   মঙ্গলবার, ০৫ অক্টোবর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   849 বার পঠিত

আয়-ব্যয়ের অনিশ্চিত যুদ্ধে অবতীর্ণ নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা

আয় কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে একজন মানুষের ব্যয়ও কমে যাওয়া। যার প্রভাব চক্রাকারে সার্বিকভাবে পড়বে অর্থনীতি ও দেশের প্রবৃদ্ধির ওপর। যদি মানুষের আয় কমে যায়, তাহলে বাজারে গিয়ে সে ব্যয় করতে পারবে না। তার যে দৈনন্দিন চাহিদা, সেটা পূরণ হবে না। এতে করে যে উৎপাদন করছে সেও তার বাজার পাবে না, সে বাজারে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করতো, মানুষ কিনতে পারছে না বলে তাকে উৎপাদনও কমাতে হবে। সে যদি উৎপাদন কমিয়ে দেয়, তাহলে যত লোক তার অধীনে চাকরি করে, তত লোক তার লাগবে না। তখন কিছু লোক কর্মসংস্থান হারাবে। এভাবে একটা চেইনের মতো কাজ করে আয় কমে যাওয়ার বিষয়টা, যা পরবর্তীতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপরে আঘাত করবে।

মহামারী করোনা ভাইরাস থেকে রেহাই পেতে রীতিমতো যুদ্ধ করছে বিশ^বাসী। এর প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনীতি ধসে পড়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বলছে, বাংলাদেশে ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের ৪ কোটি পরিবারের মধ্যে নিম্নবিত্ত ২০ ভাগ আর উচ্চবিত্ত ২০ ভাগ। মাঝের যে ৬০ ভাগ এরা নিম্ন-মধ্য ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত। এই সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবার হবে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৩৭ মিলিয়নের অধিক। যাদের প্রতিদিনের মাথাপিছু আয় ২ থেকে ২০ ইউএস ডলার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২০ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছে, করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে দেশে পরিবারপ্রতি গড়ে ৪ হাজার টাকা করে আয় কমে গেছে। মহামারীর এই সময়ে আয় কমে যাওয়ায় খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমে গেছে ৫২ শতাংশের মতো পরিবারের। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস বলছে, করোনা ভাইরাস মহামারীর আঘাতে অন্তত এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে কাজ দিতে না পারলে দারিদ্র্যসীমার ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যাবে। এতে আমাদের সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমই বাধাগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা জরিপ অনুযায়ী, করোনার আগে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২০ দশমিক ৫ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। চরম দরিদ্র ছিল ১০ ভাগ মানুষ। করোনা মহামারীর কারণে এখন সেটা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বিআইডিএসের সাম্প্রতিক জরিপে বলা হচ্ছে, করোনায় এক কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। তাই এখন দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা ৫ কোটির বেশি।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী খাতে প্রায় ৮০ লাখ শিল্পোদ্যোগ আছে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশই হচ্ছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি মানের (এসএমই) শিল্পখাত। বাকি দুই শতাংশ হচ্ছে গার্মেন্টস এবং ফার্মাসিউটিক্যালস খাত। বাংলাদেশের তিনটি প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রÑকৃষি, শিল্প, সেবাখাত। যা দেশের জিডিপিতে যথাক্রমে- ১৮ শতাংশ, ২৯ শতাংশ এবং ৫৩ শতাংশ অবদান রাখে। করোনা ভাইরাস মহামারীতে এই তিন খাত বিরূপভাবে প্রভাবিত হয়েছে। করোনার কারণে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত ২০১৯-২০ অর্থ বছরের চূড়ান্ত হিসাবে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ কম হয়েছে। এ ছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রাথমিক হিসাবে প্রবৃদ্ধির অর্জন ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। লক্ষ্য ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। কমেছে ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তবে গত বছরের তুলনায় দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ ডলার, যা টাকার অঙ্কে এক লাখ ৮৮ হাজার ৮৭৩ টাকা। তবে প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে দেশের মোট উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর। করোনা মহামারীর কারণে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। ফলে পরিস্থিতির কারণেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম।

করোনা ভাইরাসের কারণে বেকারত্ব, গ্রামে ফিরে যাওয়া, আর্থিক সংকট, খাদ্যের অভাব, সমাজে দ¦ন্দ্ব ও অস্থিতিশীলতা বাড়িয়ে দিতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে যুদ্ধ ও মহামারীর পর এর নজির নানাসমাজে রয়েছে। করোনা ভাইরাসকে বিশ^নেতারা যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছে। আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের কারণে একটি অভ্যন্তরীণ মাইগ্রেশন হয়েছে। যে বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি হারিয়েছে, তাদের অনেকে গ্রামে ফিরে গেছে। এটি কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। অন্য সময় ঈদ বা পূজায় বাড়ি যেত, ভাই-বোনেরা বাড়িতে হয়তো থাকতো, হৈ-হুল্লোড় করতো। আর করোনায় মেগাসিটির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও খুব খারাপ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, আনুষঙ্গিক খরচ, পারিবারিক ব্যয় সবকিছুই নির্ভর করে ব্যবসার ওপর, ব্যবসা না থাকলে এসব ব্যয় কোথা থেকে আসবে। অনেকে এরই মধ্যে বিকল্প চিন্তা করছে খরচ কমানোর জন্য। বাসা ছেড়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রপ-আউট করেছে, ক্ষুদ্র, মাধ্যম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলছে। দোকান বাসা-বাড়িতে টুু-লেট বাড়ছে। ঋণের কিস্তি বকেয়া পড়ছে। রাইড শেয়ারিং করে যারা সংসার চালায় এমন অনেকেই কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর জরিপে দেখা গেছে, করোনায় ফরমাল সেক্টরে কাজ করা ১৩ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম, তাদের ৫৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ৩২ দশমিক ১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ২৩ দশমিক ২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭ দশমিক ২৬ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি তাদের ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশের কমেছে এবং ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। মহামারী করোনায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি আয় কমে গেছে মধ্যবিত্তেরও। ভোগ্যপণ্য বিশেষ করে খাদ্য ও নিত্যপণ্য কিনতেই হিমশিম হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। করোনাসংক্রমণ রোধে কখনো লকডাউন, কঠোর লকডাউন এবং কঠোর বিধিনিষেধের মুখে কাজ করে অলস সময় কাটিয়েছেন সীমিত আয়ের মানুষগুলো। তবে আয়-উপার্জন কমে গেলে ও ক্ষুধা নিবারণের জন্য স¦াভাবিক সময়ের মতো খাদ্য ও নিত্যপণ্য কিনতে হয়েছে। দেশের বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে কঠিন সময় পার করছেন। গত দেড় বছরের বেশি সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে বহুজনের। দৈনিক হিসাবে যারা কাজ করেন, তাদের বেশিরভাগই এখন কর্মহীন। একইসঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী মানুষ তো আরো বেশি কষ্টে আছেন। এদিকে জীবিকার তাগিদে বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকে বিকল্প কাজের সন্ধানে বের হচ্ছেন। নগর দারিদ্র্যরা টিকতে না পেরে রাজধানী ঢাকা ছেড়েছেন অনেকেই, এখনো ছাড়ছেন আর করোনা মহামারীর পরিস্থিতিতে চাকরির ওপর নির্ভরশীল মধ্যবিত্তদের পাশে কেউ নেই। গরিবের জন্য খাদ্য ও অর্থ সহায়তা, উচ্চবিত্তদের জন্য আছে শিল্পপ্রণোদনা, তাহলে মধ্যবিত্ত? সঞ্চয় ভোগ খেতে খেতে নিঃশে^ষ এই শ্রেণি। উল্লেখ্য, দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর সরকারের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় মোট ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মোট আর্থিক মূল্য এক লাখ ৩১ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে শিল্পে প্রণোদনার পাশাপাশি পোশাককর্মীদের বেতন-ভাতাও অন্তর্ভুক্ত। সর্বশেষ প্যাকেজটি ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নআয়ের মানুষকে রক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও পর্যটনখাতের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। এই নতুন পাঁচটি প্যাকেজে মোট তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কর্মহীন অতিদরিদ্র মানুষকে সহায়তা দিতে সারা দেশে তালিকা করে ৩৫ লাখ পরিবারকে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে দেয়া হয়। এতে সরকারের ব্যয় হয়, ৮৭৫ কোটি টাকা। দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশ নামিয়ে আনতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত বছরে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা হারে নগদ সহায়তা দেয়ার সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।

এদিকে সম্প্রতি বিশ^ব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারী করোনার কারণে গত দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো দারিদ্র্য হ্রাসের প্রবণতাটি বিপরীত হয়ে গেছে, অর্থাৎ দারিদ্র্য বাড়ছে। করোনা অতিমারী শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত হানে। তবে আশার কথা হলো বৈশি^ক মহামারীর মধ্যেও দেশ খাদ্য মজুদে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। দেশে নিরাপদ খাদ্য মজুদের ন্যূনতম পরিমাণ হওয়া উচিত ছিল চাল-গম মিলিয়ে ১১ লাখ টন। ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখ পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, খাদ্যশস্যে সরকারি মোট মজুদ ১৭ দশমিক ৭০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১৫ দশমিক ৭০ লাখ মেট্রিক টন, গম ১ দশমিক ৫৫ লাখ মেট্রিক টন, ধান শূন্য দশমিক ৪০ লাখ মেট্রিক টন। করোনার মধ্যেও রাজস্ব আহরণ, রফতানি আয়, কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য ইতিবাচক। ফলে ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হচ্ছে।

 

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৫ অক্টোবর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।