পান্না কুমার রায় রজত | বৃহস্পতিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৩ | প্রিন্ট | 522 বার পঠিত
বিশ্বের বর্তমান অবস্থা একেবারেই অন্যরকম। মানব সভ্যতা এই আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি কোনো দিন হয়নি। নীতি নির্ধারকরা এবার কী করবেন? বিশ^বাজার এই ভাবে কোনও দিন সব দেশকে এ শৃঙ্খলে বাধেনি। এইভাবে তাই কোন দিনই এক দেশের নীতি অন্য দেশের বাজারকে এতটা প্রভাবিত করতে পারেনি। কিন্তু আজ রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের অভিঘাতকে আরও তীব্র করে তোলে চরম মুদ্রাস্ফীতিতে ইন্ধন দিয়ে। মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক চিত্র হলেও বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির জন্য অভিঘাত হিসেবে দেখা হয়। সহজ ভাষায় বললে, একটি দেশের বাজারে পণ্যের মজুদ এবং মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। যদি পণ্যের তুলনায় মুদ্রার সরবরাহ অনেক বেড়ে যায় অর্থাৎ দেশটির কেন্দ্রিয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় টাকা ছাপায় তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। এর ফলে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি মুদ্রা খরচ করতে হবে। এর মানে জিনিষ পত্রের দাম বেড়ে যাবে। বিশ^জুড়ে গড় মুদ্রাস্ফীতির হার ৯ শতাংশ। আর এক শাঁকের করাত কেটে চলেছে বাজারের গলা। মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে শীর্ষ ব্যাংকগুলোর হাতে সেই প্রথাগত অস্ত্র। সুদের হার বাড়ানো, আর বাজারে সুদের হার বাড়া মানেই লগ্নির খরচ ও বেড়ে চলা। আর লগ্নির খরচ বাড়া মানেই বাজারের আরেক স্তরের ঝুঁকি । বিনিয়োগের ঝুঁকি যা বাড়ছে।
কোভিডের প্রথম ছোবলটা কেটেছিল আতঙ্কে আর স্বজন হারানোর ভয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় ছোবলটা ছিল অসহায়তার। চাকরি হারানো আবার কাজ খুঁজে পাওয়ার আশা। অর্থাৎ কারও বা কিছু পাওয়া আর হারানো। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ২০২২ থেকেই শুরু হয়ে গেল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ^ জুড়ে কাচাঁমাল সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় যে মুদ্রাস্ফীতির দৈত্য প্রায় প্রতিরোধহীনভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পেরেছিল, তাতে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে এই যুদ্ধ খাদ্যপণ্য সরবরাহে সমস্যা তৈরি করে। বিশে^র গমের চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ মেটায় ইউক্রেন। আর এই যুদ্ধ সেই সরবরাহ প্রায় পুরোটাই বানচাল করে বসে রয়েছে। অনেক কিছু না কিনে বা ছেড়ে বাঁচা যায়। কিন্তু না খেয়ে তো থাকা যায় না। কোভিডের কারণে পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত থাকায় খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ও বিপর্যস্ত ছিল। এবার তার সঙ্গে এই যুদ্ধ হাত মেলাতে মুদ্রাস্ফীতি সুনামির মতো গোটা বিশ^কে ছেয়ে ফেলল। ফলাফল দারিদ্র বৃদ্ধি। জিনিসের দাম বাড়ায় মানুষের প্রকৃত আয়ও কমতে শুরু করেছে। আর এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উষ্ণায়ণের কারণে বন্যা, খরা, ঝড়। যেমন সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষ।
পরিবেশবিদদের মতে যার মূলে রয়েছে উষ্ণায়ণ। একদিকে ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট আর অক্সফ্যাম রিপোর্ট-এ বিশ^জোড়া অসাম্য ও দারিদ্র্যের আশঙ্কাজনক ছবি। আর অন্যদিকে ফোর্বস ও হিউরুন-এর বিশে^র সবচেয়ে ধনীদের তালিকা প্রকাশ পাওয়ার পরে প্রতি বছরই অসাম্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে। অসাম্য এমন এক আপেক্ষিক মাপকাঠি যার থেকে প্রত্যক্ষভাবে জীবনযাত্রার মান -সে গড় আয়ই হোক, বা দারিদ্র অনুমান করা মুশকিল। অসাম্য বাড়লে তার সঙ্গে গড় আয় বাড়তেও পারে, কমতেও পারে। অসাম্য কমলেও তাই। নানা দেশে জাতীয় আয় সংক্রান্ত সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্কের সমাধান হিসাবে সম্প্রতি গবেষকরা জাতীয় আয় নির্ণয় করার একটা বিকল্প পদ্ধতি বের করেছেন কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা রাতের আলোর ছবি ব্যবহার করে। যুক্তিটা এইরকম-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যত বাড়বে এবং যত নগরায়ন হবে, রাতে আলোর ব্যবহার ততই বাড়বে এবং তার বৃদ্ধির হার থেকে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারের একটা বিকল্প পরিমাণ পাওয়া যাবে। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো’র গবেষক লুইস মার্টিনেজ দেখাচ্ছেন তুলনামূলকভাবে অগণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই মাপের সঙ্গে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হারের ফারাক বেশি। দেশের অর্থনীতির শিরদাড়া ভেঙে গেলে ঠিক কী হয় তা তো শ্রীলংকাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে শ্রীলংকা। গত বছর গোতাবায়া রাজাপাকসের প্রস্থানের পর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহন করা রনিল বিক্রমাসিংহের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করা। অর্থনীতি ঘুরে দাড়ানো শুরু করলেও বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে প্রয়োজনীয় আমদানি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফের ঋণ গুরুত্বপূর্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ আইএমএফের ঋণ অনুমোদন হলে অন্যান্য ঋণদাতারাও এগিয়ে আসবে। ভেঙে পড়া রাজনৈতিক কাঠামো গোটা দুনিয়ার সামনে শ্রীলংকাকে একটা উদাহরণ হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে।
অর্থনৈতিক সংকটে ধুঁকছে পাকিস্তান। দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। সরকারি ভান্ডার অর্থশূন্য। টাকার অভাবে ধসে পড়েছে পাক অর্থনীতি। ১৯৬০-১৯৮০ এই সময়টিকে মূলত পাক অর্থনীতির ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। এই সময়ে পাকিস্তানের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৬ শতাংশ। কীভাবে অর্থনীতিকে এতখানি এগিয়ে নিয়েছিল পাকিস্তান? আর কী এমন ঘটল যাতে গোটা দেশের অর্থনীতি নিমিষে ধসে পড়ল? কিন্তু পাকিস্তানের যাবতীয় অগ্রগতি ছিল তার অবিভক্ত অবস্থায়। সবচেয়ে লাভজনক বস্ত্রবয়ন শিল্পের মূলভিত্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তান। অভিযোগ, পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত সামগ্রী থেকে লাভের অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব এবং পশ্চিমে এই অসম বণ্টণ দেশটির কাল হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের পরাজয়। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন। পাকিস্তানের যাবতীয় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির নেপথ্যে ছিল সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ। যুদ্ধের পর তা পাকিস্তান থেকে বিছিন্ন হয়ে গেলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ‘ইঞ্জিন’ হারিয়ে ফেলে পাক সরকার। এরপর দেশটির অর্থনীতি ধসে পড়ে।
আইএমএফের তথ্য মোতাবেক, বিগত ৫০ বছরে পাকিস্তান আইএমএফ থেকে ২১ বার ঋণ নিয়েছে। যার মধ্যে ১২টিই ছিল বেল আউট। মূলত একটি দেশ যখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছায় তখন আইএমএফ দেশটির অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বেল আউট ঋণ দিয়ে থাকে। পাকিস্তানকে এতবার বেল আউট ঋণ দেয়ার পরও দেশটির মুদ্রানীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আসেনি কোন কার্যকরী পরিবর্তন। সাদা চোখে দেখলে আইএমএফের দেয়া শর্তগুলো পাকিস্তানের দোদুল্যমান রাজনীতির জন্য নেতিবাচক।
সম্প্রতি দ্য ডনের প্রতিবেদনে বলা হয় লাহোরে ১৫ কেজি আটার ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫০ রুপিতে। পাকিস্তানে এক লিটার দুধের দাম ২৫০ টাকা। এক সময় রোজের খাবারে যা থাকত সেই মুরগির দাম ও সাধ্যের বাইরে। এক কেজি মুরগির মাংসের দাম ৭৮০ টাকা এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মাথায় হাত।
দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, ৫১ টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এতোটা বেড়েছে যে, এগুলোর মুদ্রাস্ফীতি ৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে। ইতিহাসের সর্বনিম্ন ছিল পাকিস্তানি টাকার দর। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী বাজার খোলার পর দিনের শুরুতে পাকিস্তানি টাকার মূল্য ডলারের তুলনায় ছিল ১৯৮ দশমিক ৩৯ পয়সা। কিন্তু সময় পেরোতে না পেরোতেই বাজারের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। ডলারের তুলনায় রুপির দাম আরও কমে দাঁড়ায় ২০০। অর্থাৎ ২০০ পাকিস্তানি রুপি এক ডলারের সমান। ৭৫ বছরের পাকিস্তানের অর্থনীতিতে এতটা খারাপ সময় আসেনি। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পাকিস্তান এখনো নিজেদের অর্থনীতি টিকে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। সার্বভৌম দেউলিয়াত্বের বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে। আইনি দৃষ্টিকোন থেকে, একটি ডিফল্ট ইভেন্ট হল ঋণ চুক্তি নির্দিষ্টভাবে লঙ্ঘন, অর্থাৎ চুক্তিতে নির্দিষ্ট গ্রেস পিরিয়ডের বাইরে নির্ধারিত ঋণ পরিষেবা দেয়ায় সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়া। কৌশলগত দিক থেকে পাকিস্তান ইতিমধ্যেই ঋণ খেলাপি হয়েছে। কারণ, তারা চীন, সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। তবে দেশটি ৩ মার্চ চীনের কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা পেয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ৩৮০ কোটি ডলার। যা দিয়ে দেশটির এক মাসের ও ব্যয় মেঠানো সম্ভব না। অর্থনীতিকে বাচাঁতে আইএমএফ -এর দ্বারস্থ হয়েছিল পাকিস্তান। এরই মধ্যে আইএমএফ পাকিস্তানকে জানিয়েছে, ঋণ পেতে পরমাণু কর্মসূচি ত্যাগ করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমাতে হবে অন্তত ১৫ শতাংশ। এছাড়াও আরো চারটি শর্ত রয়েছে আইএমএফের। তবে মাথা যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরমাণু ত্যাগের শর্তটি। আইএমএফ জানিয়েছে, ঋণ পেতে হলে চীনা ঋণ এবং চীন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোরে বেইজিংয়ের বিনিয়োগের নিরীক্ষা করা অনুমতি দিতে হবে। সেই নিরীক্ষা করবে তৃতীয় পক্ষ। পাকিস্তানের মতোই মিশরেরও বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারে টান পড়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতি সঙ্কটে রয়েছে। জানুয়ারিতে তাদের মুদ্রাস্ফীতির হার ২৬ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে যায়। আগামী দিনে এই হার আরও বাড়বে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এর পাশাপাশি নাগরিকত্ব বিক্রি করার এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করেছে মিশরীয় সরকার। মিশর সরকার ঘোষণা করেছে যে সমস্ত লগ্নিকারী সেখানে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কমছে। তবে এটা ঠিক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বৈশি^ক অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণেই ঘটেছে। কোভিড-১৯ এর অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্বই অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে জিডিপির আকারের ভিত্তিতে বৃহৎ অর্থনীতির দেশের তালিকায় ৩৫ তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপির পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ কম ছিল। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২৭৯৩ ডলার। জিডিপি প্রবৃদ্ধির মূল কথা হলো, যে অর্থই ব্যয় করা হোক না কেন সেই আয়-ব্যয় বা ব্যবহারের দ্বারা অবশ্যই পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হতে হবে। তাহলে জিডিপির ভিত শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে হবে। সামষ্ঠিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ক্ষুদ্র পেশাজীবিদের সুরক্ষিত রাখতে হবে। তাহলে অন্তর্ভূক্তিমূলক ও পরিবেশ সম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে।
Posted ১:৩৪ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৬ এপ্রিল ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy