বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x

কোভিড পরবর্তী স্বস্তিকর গতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি

পান্না কুমার রায় রজত   |   মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   495 বার পঠিত

কোভিড পরবর্তী স্বস্তিকর গতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বিকাশ, মাথাপিছুুআয় বৃদ্ধি, সুলভে শ্রমিক প্রাপ্যতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়নসহ নানা কারণে বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের চমৎকার স্থান। অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। আর তাই বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয়ের কারণে যেসব খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমছে সেই শিল্পের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করে বিনিয়োগ করলে লাভবান হবে। শিল্পায়ন ও বৈশি^ক অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জ¦ালানি তেলের চাহিদা। সে চাহিদা যে কোন সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে যে, জীবাশ্ম জ¦ালানি দিয়ে তা পূরণ করা আর সম্ভব হবে না । তাছাড়া জলবায়ু মানুষের বাসযোগ্য রাখতে বিশ^ব্যাপী এখন সর্বাধিক জোর দেয়া হচ্ছে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির উপর। জাপান, জার্মানী, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশ এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে ব্যাটারি চালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে আসবে। এর সঙ্গে সামিল হচ্ছে বাংলাদেশও জ¦ালানি, নবায়নযোগ্য জ¦ালানি, জাহাজ নিমার্ণ, অটোমোবাইল, লাইন ইঞ্জিনিয়ারিং,এগ্রো প্রসেসিং, ব্লু-ইকোনমি, ট্যুরিজম হাইটেক ইন্ডাষ্ট্রিজ ও তথ্য প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক খাতে সুবিধা নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে।

শেয়ারবাজারকে আকৃষ্ট করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) দুবাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডে পৃথক পৃথক রোড শো করেছে। চলতি বছরের ৯ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ে চার দিনব্যাপী রোড শো আয়োজন করে বিএসইসি। এটির নাম ছিল ‘রাইজিং অব বেঙ্গল টাইগার পটেনশিয়াল অব বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেটস’। যেখানে অনিবাসী বাংলাদেশী সুকুক বা ইসলামিক বন্ডে আগ্রহী এঞ্জেল ইনভেস্টর, ভেঞ্জার ক্যাপিটালিস্ট সহ বিভিন্ন সেক্টর থেকে আগত অতিথিদের পরবর্তীতে একই প্রতিপাদ্য যুক্তরাষ্ট্রের চার শহরে গত ২৬ জুলাই থেকে আগষ্ট, রোড শো’র আয়োজন করা হয়। এই রোড শোর উদ্বোধন হয় ২৬ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত। ২৬ জুলাই নিউইয়র্ক এরপর ২৮ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি, ৩০ জুলাই লস এঞ্জেলেস এবং ২আগষ্ট সানফ্রান্সিসকোতে শেষ রোড শো আয়োজিত হয়। সর্বশেষ রোড শো অনুষ্টিত হয় সুইজারল্যান্ডে গত ২০ সেপ্টেম্বর। সেখানেও একই প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে রোড শো অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতি পণ্য ও সেবা শেয়ার বাজার সহ যাবতীয় বিষয়ে আলোচনা করা হয়। সর্বোপরি বিনিয়োগ আনয়নের জন্য আমেরিকা, লন্ডন, সিঙ্গাপুর ব্যয়বহুল ‘রোড শো’ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারও খুব একটা শক্তিশালী নয়। ডিএসই ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত জুন ২০২১ শেষে জিডিপিতে পুঁজিবাজারের অবদান বাংলাদেশে ৯.৪১%। ভারতে ৬২.৭৫%। শ্রীলঙ্কায় ১৪.৯২%। থাইল্যান্ডে ৮৯.২৯%। চীনে ৩৭.২৩%।

বাংলাদেশ থেকেও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন দেশে বিপুল বিনিয়োগ হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২০‘ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট স্টেটমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, দেশের বাইরে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের ‘আউটওয়ার্ড ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের’ পরিমাণ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর ছিল ৩০৭ দশমিক ৫০ কোটি ডলার। অর্থাৎ দেশে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আসছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ দেশের অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে। অথচ দেশে বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান হতো। বিদেশি বিনিয়োগ টানতে রোড শো চলাকালীন সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জ হোলসিমের বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটানোর গুঞ্জন রয়েছে। এর আগে সনোফি এভেনটিসের শেয়ার বেক্সিমকো ফার্মার কাছে বিক্রি করা হয়েছে। বেক্সিমকো ফার্মা সনোফির শেয়ার অধিগ্রহণ করেছে। এ ছাড়া ঔষধ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানি জিএসকে (গ্লাক্লোস্মিথক্লাইন) বাংলাদেশের ঔষধ ইউনিটের শেয়ার কিনে নিয়েছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ। তবে বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা ছেড়ে দিতেই পারে যদি তাদের টার্গেট পূরণ হয়ে যায়। আবার সেই কোম্পানি যদি বাংলাদেশি উদ্যোক্তা অধিগ্রহণ করে তাহলে তা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক। তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অতিমাত্রায় আর্থিক সুবিধা পেতে চায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বর্হিবিশে^ সুনামের সাথে ব্যবসা এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশেও তাদের তালিকাভুক্তির বিষয়টি আমাদের দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিতে হবে তা না হলে ভালো কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে না। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে সরকার। ৯৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন পেয়েছে তার মধ্যে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সরকারি- বেসরকারি ২৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। ইতোমধ্যে নতুন ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্থানগুলোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে নতুন শিল্পে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। এতে গোটা দেশেই শিল্প-বিপ্লব যেমন ঘটবে ঠিক তেমনি দেশে বেকার মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে। আর অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। শুধু শেয়ারবাজারে বিদেশী বিনিয়োগের আহ্বান না করে উল্টো সামগ্রিক অর্থনীতির কথা বিবেচনা করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য রোড শোর দরকার হলেও ভালমানের কোম্পানি বাজারে আনতে হবে। কারণ বিদেশিরা ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে থাকেন। ভালোমানের কোম্পানি তালিকাভুক্তির জন্য শেয়ারবাজারে অনৈতিক চর্চা বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির পাশাপাশি বন্ড মার্কেটকেও শক্তিশালী করতে হবে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প খাত বিকাশের আগে আশির দশকে সোনালী আঁশ পাট ছিল অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। সরকারি পাটকলগুলো নিজেদের দক্ষতা উন্নয়ন ও পণ্য বৈচিত্র্যায়ন করতে না পারায় দিনে দিনে ব্যবসা হারিয়ে রুগ্ন হয়ে পড়েছে। প্রতিবছর লোকসান গুনছে। অন্য দিকে সরকারি পাটকলের বিশাল সম্পদ অব্যবহৃত আছে। সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ১৪ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এ হিসাবে এই খাতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশে, যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বিজেএমসি তথ্য মতে, বাংলাদেশে পাটকলগুলোর স্থায়ী সম্পদ অনেক বেশি। বিশাল জায়গা থাকলেও তা অব্যবহৃত। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পাটকলগুলো চালু করা গেলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। গত এপ্রিলে ‘বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন’ সরকারি পাটকলগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। গত ১৫ জুন আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের দরপত্র আবেদন জমা দেয়া শেষ হয়েছে এবং প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় বাংলাদেশ জুট মিলসের ইজারা পেতে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে। এই মিলটি ইজারার জন্য ১১ টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। ইতোমধ্যে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় বেসরকারি উদ্যোগে সম্পূর্ন প্রবাসীদের বিনিয়োগে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপনের কাজ চলছে। ‘আমেরিকান লিবার্টি পাওয়ার বিডি লিমিটেড’ নামে প্রবাসী বাংলাদেশীদের এই প্রতিষ্ঠান প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফেঞ্চুগঞ্জে গড়ে তুলেছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। যা প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিবাচক। বিশ^ব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সামনেও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এসেছে। ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে বিশে^র বহুদেশ তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনছে। চীন ও আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে চীন থেকে বিপুল পরিমান বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে জাপান সরকার। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে নির্মানাধীন বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে জাপানি বিনিয়োগ আসার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

করোনার কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে বড় একটা সময় ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত ছিল। তারপরও আগের বছরের তুলনায় এ খাত থেকে আয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ প্রদান, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ঋণের হিসাব, আমদানি-রপ্তানিসহ ব্যাংকের সব ধরণের সার্ভিস চার্জ থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট পায়। এছাড়া ব্যাংকের কেনাকাটায় ও দিতে হয় উৎসে ভ্যাট। এনবিআরের তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকের এসব চার্জের ওপর ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ভ্যাট পেয়েছে সরকার। আগের অর্থবছরে এ খাতে আদায়কৃত ভ্যাট ছিল ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডও চাঙা হচ্ছে। অধিকাংশ কারখানাতেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির বিজ্ঞাপণ ঝুলছে। পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ বাড়ছে ফলে নতুন দক্ষ কর্মীরও প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি মিয়ানমার, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে পোশাকের কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়ে আসছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছে। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে অর্থনীতি এখন গতিশীল এমনটাই বলছেন অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারা। দোকানপাট, শপিংমল, অফিস, আদালত, ছোট বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বীমা, শিল্প-কারখানা, সড়ক, নৌ, রেল, আকাশ পথের পরিবহনসহ সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এ মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষের মনে এই স্বস্তি সামষ্টিক অর্থনীতির এক ধরণের ইতিবাচক প্রভাব।

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৮:০৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।