বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

Ad
x

জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও নতুন মুদ্রানীতির সমীকরণ

পান্না কুমার রায় রজত   |   রবিবার, ০৬ আগস্ট ২০২৩   |   প্রিন্ট   |   270 বার পঠিত

জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও নতুন মুদ্রানীতির সমীকরণ

গত ১৮ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জুলাই-ডিসেম্বর নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করতে মুদ্রানীতির ঘোষণা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্বে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিতো। এবার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে সুদহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এজন্য ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের সীমা আর থাকছে না। ঋণের সুদহারকে বাজারভিত্তিক করার অংশ হিসেবে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। এই মুদ্রানীতি ছয় মাসের জন্য অর্থাৎ জুলাই থেকে কার্যকর এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। সুদের হার নির্ধারণের পদ্ধতিকে শর্টটার্ম মুভিং অ্যাভারেজ রেট বলে অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছে। সুদের হার নির্ধারণ করা হবে ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদের সঙ্গে সর্বো”্চ তিন শতাংশ যোগ করে। আর সিএমএসএমই (কটেজ, মাইক্রো, স্মল, মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) এবং ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে যোগ করতে পারবে চার শতাংশ । বর্তমানে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার সাত শতাংশের নিচে। ব্যাংকবহির্র্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ট্রেজারি বিলের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ যোগ করতে পারবে।

গত ১ জুন-২০২৩ আর্থিক বছর ২০২৩-২০২৪ এর জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশের ৫২ তম বাজেট সংসদে পেশ করেন এবং ২৬ জুন তা মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়। বাজেটে ব্যয়ের আকার ধার্য করা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা যা জিডিপির আকারে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ এবং গত অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শীর্ষক প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক ঘাটতি ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বিদেশী উৎস থেকে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে। আবার বাজেটে সরকার ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর মেয়াদে সরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৩ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে জানুয়ারি-জুন সময়ে ছিল ৪০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই-ডিসেম্বর যেখানে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। বিগত অর্থবছরে জানুয়ারি-জুন সময়ে যা ছিল ১১ শতাংশ। এ থেকে প্রতীয়মান হয় বর্তমান বৈশি^ক অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস পেয়েছে। ২০১৪ সালে ঋণ-জিডিপির অনুপাত ছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে ৪২ শতাংশ। ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেড়ে গেছে। মাথাপিছু ঋণ আগে ২৫৭ দশমিক ৪৭ ডলার ছিল। এখন ৫৫৭ দশমিক ৫৯ ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ আগে ছিল ২৩ শতাংশ তা এখন ৩০ শতাংশ। কর-জিডিপি অনুপাতের উন্নতি ও হচ্ছে না। তাই দেশকে আরো বেশি ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে ১ ট্রিলিয়ন টাকার ওপরে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ায় মুুদ্রিত অর্থ বাজারে প্রবেশ করছে। ভোক্তামূল্যের মাত্রা আরো বেড়ে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে।

অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য অভিঘাত স্বরূপ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমায়। ক্ষুধা বাড়ায়। সহজ কথায়- মূল্যস্ফীতি বলতে পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়া বোঝায়, যা সাধারণত অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে ঘটে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজারে পণ্যের মজুদ ও মুদ্্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংক যখন অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপে তখন মূল্যস্ফীতি ঘটে। ফলে মুদ্রার মান ও ক্রয় ক্ষমতা কমে। এছাড়া দুর্যোগ, যুদ্ধে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, ব্যাংকের সুদহার কমানো, ভর্তুকি ও আমদানিনির্ভরতার কারণেও মুল্যস্ফীতি বাড়ে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সাথে সাথে যদি জনগণের আয় বৃদ্ধি না পায়, তাহলে মূল্যস্ফীতির প্রভাব জনজীবনে দুর্ভোগ নিয়ে আসতে পারে। যদি বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয় তবে অবশ্যই সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অর্জিত হবে। ১২ বছরের মধ্যে গত মে মাসে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে বাংলাদেশে। মূল্যস্ফীতির যুক্তি ছিল দুটি, কোভিডকালীন ও ইউক্রেন যুদ্ধ। এই দুটি কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম স্বাভাবিক হয়ে এলে আমাদেরও স্বাভাবিক হবে। কিন্তু অনেক দিন ধরে তেলের দাম স্বাভাবিক হয়ে ব্যারেল প্রতি ৭০-৮০ ডলারে নেমে এসেছে, কিন্তু দাম কমেনি। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, আমাদের অর্থনীতি অনেক দিন ধরেই ভুল নীতির ওপর চলছে। এখন ডলারের তিন ধরণের রেট আছে। এটা বাজারের হাতে ছেড়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে তা নয়, আমাদের ডলার ক্রাইসিস আছে। সেটা আগে সামাল দিতে হবে। মুদ্রানীতিতে পরির্বতন এসেছে নীতি সুদ হারে। রেপো রেটে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট ও রিভার্স রেপো হার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে একদিন মেয়াদি রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার ৬ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। রিভার্স রেপো হার জুলাই থেকে এসডিএফ নামে পরিচিত হবে। আগের ৪ দশমিক ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে যে, সুদের হার বাড়লে টাকার সরবরাহ কমে। এখন সেটা যদি ব্যাপকভাবে করা হয় আর সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে ধার করে তাহলে ব্যক্তি খাত টাকা পাবে কোথায়? বাস্তবে এই পদক্ষেপ কোনো কার্যকর ফল বয়ে আনবে? সরকারের বাজেট বাস্তবায়নকে সহায়তা করে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে একটি সময়ে বাজারে কী পরিমাণ অর্থের প্রবাহ থাকবে তা নির্ধারণ করা হয় মুুদ্রানীতির মাধ্যমে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর বলেছেন, আগে সুদের হারে ক্যাপ বসানো হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। সে সময় সারা বিশ্বে সুদের হার কম থাকলেও বাংলাদেশে বেশি ছিল। তাই ক্যাপ দেওয়া হয়েছে। এখন ওই ক্যাপ ওঠানো হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। তবে পলিসি মেকারদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে সুদের হারে ক্যাপ বসিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। যা হোক আমাদের অর্থনীতি গতিশীল ও সামষ্টিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকুক তা সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বুঝতে পেরেছে এতেই বা কম কী!

অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতি যদি দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সেটি নেতিবাচক। স্বাভাবিকভাবেই দেশে জিডিপির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হারের প্রবণতা বেশি। এ প্রেক্ষাপটেই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির লাগাম ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। উন্নত বিশ^ মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা করছে সুদের হার বাড়িয়ে। সুদের হার বাড়ানোর পেছনের যুক্তি সুদ বেশি হলে লোকে ধার করবে কম, জিনিসপত্র কম কিনবে ফলে দাম তত বাড়বে না। এই যুক্তি বাস্তবে কাজ করে কি না তা তর্কের বিষয়, তবে দুটো কথা এই প্রসঙ্গে আসবে। এক, সুদ বাড়ানোর কঠোর নীতি অর্থব্যবস্থাকে গভীর মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ফলে বাড়তে পারে বেকারত্ব। ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ফলে পরিস্থিতি আর ব্যয় সংকোচনের জন্য কোম্পানিগুলো বেছে নেয় ছাঁটাইয়ের রাস্তা। ভোক্তা ব্যয় সংকুচিত হয়ে যায়। কারণ সুদের হার তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলে ভোক্তার ওপর যা মন্দাকে ত্বরান্বিত করে। গত শতকের সত্তরের দশকে খনিজ তেলের দাম বাড়ার ফলে বল্গাহীন মূল্যবৃদ্ধি হয় যার মোকাবিলায় আমেরিকা সুদ বাড়ায় ও তারপর আসে আর্থিক মন্দা। দুই, বিভিন্ন দেশের সুদের হারের মধ্যে সাযুজ্য থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ যে হারে সুদ বাঁধে তা গোটা দুনিয়াকে প্রভাবিত করে। আমেরিকায় সুদ বাড়লে দুনিয়ার লগ্নি পুঁজি সেদিকে ট্রার্ন করে। পুঁজি ধরে রাখতে রিজার্ভ ব্যাংক ও সুদ বাড়ায়। যারা সঞ্চয়নির্ভর, চড়া সুদ তাদের জন্য সুখবর, কিন্তু চড়া সুদের চাপ পড়ে সরকারি তহবিলের ওপর, কেননা ঋণ বাবদ সরকারকে সুদ দিতে হয়। সুদের হার চড়া হলে সরকারের খরচ বাড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে সুদের খরচ বাড়লে সরকারের কাছে উপায় কী? এক, বেশি ঋণ নেওয়া, যাতে অন্য সরকারি খরচ বহাল রাখা যায়। এতে সমস্যা হলো বেশি ঋণ নিলে তহবিলে ঘাটতি বেড়ে যাবে। দুই, ঋণের খরচ সামলাতে অন্য খরচ কাটছাঁট করা হয়, যাতে ঘাটতি না বাড়ে। তিন, কর বাড়িয়ে আয় বাড়ানো যায়। এতে ঘাটতি বাড়বে না অন্য খরচ আগের মতো বহাল থাকবে। কিন্তু সম্পদ কর বা করপোরেট কর বাড়িয়ে সরকারের আয় বাড়িয়ে কর আদায় করলে ধনকুবেরদের থেকে আদায় করতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এটা কি সম্ভব? শতাব্দী বদলে যায়। সমাজ ও অর্থনীতির রূপ পাল্টায় নতুন আর্থিক সমস্যার জন্ম হয় অথচ সমাধান করার জন্য পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার কাছে যে হাতিয়ারগুলো আছে সেগুলো কি আরো নতুন কোন পথ দেখাবে?

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৭:০৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৬ আগস্ট ২০২৩

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
প্রকাশক : সায়মুন নাহার জিদনী
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।