পান্না কুমার রায় রজত | বৃহস্পতিবার, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট | 423 বার পঠিত
করোনা মহামারীর রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আর এই সংকটের সময় টিকে থাকতে বাড়াতে হবে কর্মসংস্থান। আর সে জন্য বিনিয়োগ দরকার। বাজারে নগদ টাকার জোগান কেমন হবে? কতটা ঋণ দেয়া হবে উদ্যোক্তাদের? সরকারই বা কতটুকু ধার করতে পারবে ব্যাংকিং খাত থেকে। মুদ্রানীতির মাধ্যমে এমন সব লক্ষ্যই নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্যোগ জানিয়ে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে কি পরিমাণ মুদ্রা সরবরাহ করা হবে তার একটি আগাম ধারণাপত্র দেওয়া হয় মুদ্রানীতিতে। গত বছরের ৩০ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। এখন থেকে আবার এক অর্থবছরে (আর্থিক বছর, ১জুলাই থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ৩০ জুন) দু’টি মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে কেন্দ্র্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক বছর ধরে এক অর্থবছরে একটি মুদ্রানীতিই ঘোষণা করা হতো। কিন্তু আইএমএফের পরামর্শে গত ১৫ জানুয়ারি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জানুয়ারি-জুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানতে সর্বনিম্ন সুদহার পুরোপুরি তুলে নেওয়া হলো। এ ছাড়া নতুন মুদ্রানীতিতে ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে সুদহার ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এখন ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করতে পারবে ব্যাংকগুলো। তবে শিল্পঋণসহ অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। নতুন মুদ্রানীতিতে রেপো রেট বা নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো রেট ৫.৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। আর রিভার্স রেপো হার আগের ৪ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪.২৫ শতাংশ করা হয়েছে। রেপো রেট শব্দটি রিপারচেজিং অপশন বা পুনঃক্রয় চুক্তি থেকে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ ঘাটতির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদহারে অর্থ ধার দেয় সেটাই রেপো রেট। আর রিভার্স রেপো রেট হলো যে সুদহারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। ভোক্তাঋণের সুদহার ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে ক্রেডিট কার্ড ঋণের ক্ষেত্রে কোন সীমারেখা থাকছে না। আশা করা হচ্ছে, তাতে বাজারে টাকার সরবরাহ হ্রাস পাবে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে এবং আমানত বৃদ্ধি পাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, বাজারে অর্থপ্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। এসব তহবিলের সুদহার দেড় থেকে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ। তাই ব্যাংকগুলো কৃষি, সিএসএমই , রফতানিমুখী শিল্পসহ উৎপাদনমুখী বিভিন্ন শিল্পের জন্য গঠিত তহবিল থেকে অর্থ নিতে পারবে। এর মাধ্যম দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে। ‘সুদহার বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলো রেপো থেকে ধার নেয়ায় নিরুৎসাহিত হবে। ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ানো হলে দেশের রফতানি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে ঋণের সর্বোচ্চ সুদের ক্যাপ তুলে নেয়া হয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে জানা যায়। রেপোর সুদহার বাড়ানো হলেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশেই ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ভোক্তাঋণের ক্ষেত্রে এ সুদহার সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখন থেকে ব্যাংকগুলো নিজেদের চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রাহকদের সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। সহজ ভাষায় বলা যায়, ভোক্তাঋণ মূলত ব্যক্তিগত ঋণ, গাড়িঋণ, আবাসন ঋণ, শিক্ষাঋণ প্রভৃতি। তাহলে ভোক্তাঋণের হার ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে কিন্তু ব্যবসায়ী ঋণ বা শিল্পঋণের হার বাড়ানো হয়নি। ঋণের ক্যাপ বহাল রাখা হয়েছে। ফলে বড় ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে। তারা কম সুদে ঋণ নিয়ে লাভ করবে বেশি। অর্থনীতিবিদরা বারবার বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ তুলে দেওয়া জরুরি। কিন্তু তা করা হলো না। যেহেতু উচ্চ মূল্যস্ফীতির কালেও তুলনামূলক কম সুদে উদ্যোক্তারা ঋণ গ্রহণ করতে পারছেন তাই একশ্রেণির উদ্যোক্তা ও সাধারণ ঋণগ্রহীতা আগের চেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করছেন। কিন্তু গ্রহীতা এ ঋণের অর্থ শিল্পে ব্যবহার না হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। এর প্রমাণ হচ্ছে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। তাহলে ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের অর্থ কোথায় যাচ্ছে? অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে এক শ্রেণির মানুষ তা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি মূল্যস্ফীতির পারদ ঊর্ধ্বমুখী। অস্থির মুদ্রাবাজারও। ডলার লেনদেন হচ্ছে ১০০ টাকার উপরে। পাশাপাশি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার উপর বহু নিষেধাজ্ঞা। তাই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে সরকার অর্থসংকটের কারণে ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল পয়ে পড়েছে! কিন্তু কেন এই অর্থ সংকট? লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায় কম হওয়ার কারণেই সরকারকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে। তবে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় এর প্রভাব কি হবে সেটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সরকারের এই ঋণ নেয়ার মাত্রা অব্যাহত থাকলে বড় সংকটে পড়বে ব্যক্তি বা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ। কারণ ব্যাংকগুলো ব্যক্তি পর্যায়ে ঋণ দেয়া কমিয়ে দিবে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প গুলোর কাজে ও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের আমানত কমছে। ঋণ প্রদানের প্রবৃদ্ধির হার আমানতের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। এখন আমানতের ওপর প্রযোজ্য সুদের ৬ শতাংশ সিলিং তুলে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো বেশি সুদে আমানতকারীদের আকৃষ্ট করতে পারবে। তাতে তাত্ত্বিক অর্থে মোট আমানত বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ভোক্তাঋণ ছাড়া অন্যান্য ঋণের ক্ষেত্রে ‘আপার ক্যাপ’ ৯ শতাংশ অপরিবর্তিত রাখায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৭ বা ৮ শতাংশ হারের বেশি সুদ আমানতকারীদের দিতে পারবে না। এই হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি না। উল্লেখ্য যে, ভোক্তাঋণের পরিমাণ মোট ঋণের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হতে পারে, বাকি ৯০ শতাংশই শিল্প ও উদ্যোক্তা ঋণ। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের সঞ্চয় কমেছে, ভোগও কমেছে। এমতাবস্থায় কেবল ভোক্তাঋণের সুদহার বাড়িয়ে বাস্তবে ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। আমানত গ্রহণ ও ঋণ প্রদান উভয় ক্ষেত্রেই আপার ক্যাপ তুলে দিয়ে সুদের হার বাজার ভিত্তিক নির্ধারণের সুযোগ দিতে হবে। মুদ্রানীতির পরিবর্তন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষ্য হলো, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাঙ্কিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মুদ্রানীতিতে এই পরিবর্তন।
দেশের ব্যাংকগুলোর আমানত কমছে। ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৪৪ শতাংশ। আর ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩.৮২ শতাংশ। অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশি ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। ফলে, ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে। আমানতের সুদ মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হওয়ায় অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। ফলে, আমদানি খরচ ও বেড়েছে ৪.৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে গত জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২ সময়ে পণ্য রফতানি হয়েছে ২ হাজার ৭৩১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৫৮ শতাংশ বেশি। আর জুলাই-ডিসেম্বর ২০২২ সময়ে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ৪৯ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৪৮ শতাংশ বেশি। গত ডিসেম্বরেও ২০২২ শুধু একটি ইসলামি নামের ব্যাংকেরই আমানত কমেছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। ফলে সার্বিকভাবে আমানত কমে গেছে। গত অক্টোবরে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯০ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, নভেম্বরে যা ৩ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। পাশাপাশি বেশি দামে ডলার ক্রয়, রেমিট্যান্স কেনা, রফতানি বিল নগদায়নে গ্রাহকদের বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। আবার ব্যবসা মন্দার কথা বলে ব্যবসায়ীরাও ঋণ পরিশোধ করতে চাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। গত বছর ২০২২ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে সব মিলিয়ে ১ হাজার ২৬১ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সময় প্রতি ডলার ৯৮ টাকা হিসাবে যার পরিমান দাঁড়ায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো থেকে এই পরিমাণ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভোল্টে চলে যাওয়াতে এই সমস্যা হয়েছে অর্থাৎ অর্থ সংকট বেড়েছে। ফলে, কিছু কিছু ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর-ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) ধরে রাখতে পারছে না কিছু কিছু ব্যাংক। গত ৬ মাসে জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬৫ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ধার করেছে বাংলাদেশ সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া এ ঋণের টাকার অর্ধেকের মতো ব্যয় হয়েছে সরকারের বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ৩৩ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে। ফলে বেসরকারি ব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ কমলেও বেড়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণের পরিমাণ। ইসলামি নামের পাঁচ ব্যাংকের পাশাপাশি গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর ২০২২ রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক ও চাহিদা মতো সিআরআর রাখতে পারেনি। রাজস্ব আদায় যদি বাড়ে তাহলে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পুরো অর্জিত হবে। অর্র্থনীতিবিদদের মতে, অনেক সময় সরকারের মেগা প্রকল্প এবং নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প কাট-ছাট করা সম্ভব হয় না, ফলে অভ্যন্তরীণ ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়তে সরকারকে বাধ্য হতে হয়। অভ্যন্তরীণ খাতে ঋণ না পেলে অনেক সময় সরকারকে চড়া সুদে বিদেশি উৎস থেকে ও ঋণ নিতে হয়ে যা পরবর্তীতে চাপ তৈরি করে। কারণ সেটা পরিশোধ আসলে দেশ এবং দেশের মানুষকেই করতে হয়। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে অতিরিক্ত ঋণের ফলে তা কীরূপ বিরূপ প্রভাব তৈরি করেছে তার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যায়, সরকারি রিজার্ভে বড় ধরনের ধ্বস নামা এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে শুরু করে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যমানে প্রভাব ফেলা। তাই এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারের আয় বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারকে বিভিন্ন সময়ে গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের মূল্য বাড়াতে হয়েছে। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণই হলো অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতি দূর করতে হলে অর্থের পরিমাণ কমানোর বিকল্প নেই। এ অর্থের পরিমাণ কমাতে ব্যাংক সৃষ্ট ঋণের পরিমাণও কমাতে হবে।
ব্যাংকগুলো আগের তুলনায় কম ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছে । তাতে নিত্যপণ্য আমদানিতে ভাটা পড়ছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ না থাকায় ঘটছে মূল্যস্ফীতি। এ মূল্যস্ফীতি চাহিদা বৃদ্ধির জন্য নয়। সরবরাহ সংকটের জন্য। জ¦ালানি তেলের দাম ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বেড়েছে। তাছাড়াও ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমায় বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়েছে । ফলে লাগামহীন হয়ে পড়েছে মূল্যস্ফীতি। গত ২০২২ সালের বেশিরভাগই কেটেছে ডলার সংকট নিয়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে পণ্য আমদানিতেও। তবুও ডলার সংকট সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। আসছে রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মাসে ১ লাখ ৭০ হাজার টনের মতো ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। তবে রমজান মাসে চাহিদা দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন লাখ টন। আগামী মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে রোজা শুরু হচ্ছে। রোজার সময় ভোজ্য তেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুর ও পেঁয়াজের চাহিদা বেড়ে যায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, গত ডিসেম্বর থেকেই রমজানকেন্দ্রিক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির এলসি খোলা শুরু হয়েছে। সারা বছরের নিত্যপণ্য আমদানি ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ রমজানের পণ্য আমদানিতে খরচ হয়। তবে ডলার সংকটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি বিল পরিশোধে দেরি হচ্ছে, ঋণপত্র জটিলতার কারণে পণ্য খালাস বন্ধ যাতে না হয় এবং নিত্যপণ্যের আমদানি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে যাবতীয় সাপোর্ট অব্যাহত রাখতে হবে। প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, মূল্যের স্থিতিশীলতা এবং মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ভারসাম্য রক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ অর্জন সম্ভব করার জন্য সরকারি, বেসরকারি খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন- পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। তাই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোনো বিনিয়োগকারীর জন্যই দীর্ঘমেয়াদি করনীতি একটা আস্থার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তাই বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে করনীতির স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মন্দা ভাব সৃষ্টি হয়েছে এবং বৈশি^ক সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ মানুষের প্রকৃত আয় এবং পারিবারিক কল্যাণ হ্রাস করে। এটি বেতনভোগী নিম্ন মধ্যম এবং মধ্যম আয়ের পরিবারের দুর্দশা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই উচ্চ মুল্যস্ফীতির সময়ে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে পর্যাপ্তভাবে কভার করার জন্য যথাযথ পরিবীক্ষণের সঙ্গে ওএসএস স্কিমকে শক্তিশালী করা উচিত।
Posted ৩:১৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy