পান্না কুমার রায় রজত | বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১ | প্রিন্ট | 559 বার পঠিত
বাংলাদেশের বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, গার্মেন্টস, ওষুধ কোম্পানি কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কাজ করছেন অনেক বিদেশি নাগরিক। এসব কর্মীর মধ্যে আছে ভারত ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকরা। এরপর পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কোরিয়া ও চীন থেকে আসা কর্মীরা। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, তাদের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের ২৪ শতাংশ তৈরি পোশাক কারখানায় বিদেশি কর্মীরা কর্মরত আছেন।
সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) নামের একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা করে থাকে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত তাদের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ যার শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি তার চাকরি পাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা তত কম। যারা দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু যারা স্নাতক, অনার্স, মাস্টার্স পাস করেছে, তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সুখের বিষয়, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্রুতগতিতে বেড়ে যাচ্ছে।
আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রীতকরভাবেই অব্যাহত আছে। আমরা এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময়ে আছি। মোট জনসংখ্যার এই সুসময়কে আমাদের ব্যবহার করতে হবে। কারণ একটি জাতির জীবনে তা একবারই আসে, ৩০-৩৫ বছর স্থায়ী হয়। এই সময়ে দেশকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়। এরপর নির্ভরশীল জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হলে তখন আর কোনো সমস্যা হয় না। তাই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে আমাদের কাজের উপযুক্ত করে যোগ্য জায়গায় স্থান দিতে হবে।
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা বৈধপথে বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় হিসেবে নিয়ে যান, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার সমান। রফতানিমুখী তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে এসব বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। বাংলাদেশে কত বিদেশি নাগরিক কাজ করেন, তার একটি হিসাব বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এদেশে ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন, চীনা ১৩ হাজার ২৬৮ জন। এরপর রয়েছে জাপানি ৪ হাজার ৯৩ জন। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার ৩ হাজার ৩৯৫ জন, মালয়েশিয়ার ৩ হাজার ৮০ জন ও শ্রীলঙ্কার ৩ হাজার ৭৭ জন, থাইল্যান্ডের ২ হাজার ২৮৪ জন, যুক্তরাজ্যের ১ হাজার ৮০৪ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ১ হাজার ৪৪৮ জন, জার্মানির ১ হাজার ৪৪৭ জন, সিঙ্গাপুরের ১ হাজার ৩২০ জন, তুরস্কের ১ হাজার ১৩৪ জন কর্মরত আছেন। অবশ্য অভিযোগ আছে, প্রচুরসংখ্যক বিদেশি নাগরিক পর্যটক ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করেন। তারা কখনো আনুষ্ঠানিক হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হন না। বাংলাদেশ পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৯৪৮ জন, ২০১৫ সালে ১ লাখ ৪১ হাজার ৯১৭ জন, ২০১৬ সালে ২ লাখ ৯৯৫ জন, ২০১৭ সালে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯১ জন, ২০১৮ সালে ২ লাখ ৬৭ হাজার ৭০৭ জন এবং ২০১৯ সালে জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ১ লাখ ৮৯ হাজার ৮৮৭ জন বিদেশি পর্যটন ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশে ভ্রমণে আসা বিদেশি নাগরিকদের সবচেয়ে বড় অংশই আসে তৈরি পোশাকখাতে ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে। এরপর রয়েছে উন্নয়ন খাতের বিভিন্ন কাজে। বিদেশি নাগরিকরা সাধারণত ট্যুরিস্ট ভিসা বা অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং পরবর্র্তীতে কাজ করার অনুমতি না নিয়ে চাকরিতে যোগ দেন এবং কাজ করতে থাকেন।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় উল্লেখযোগ্য প্রবাসী আয় যায় না, কিন্তু এদেশে পোশাকখাতে শ্রীলঙ্কার অনেক নাগরিক কাজ করেন।
দেশে বিদেশি নাগরিকদের কাজের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) ও এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। বাংলাদেশে বিদেশিরা সাধারণত কাজ করেন কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, যন্ত্রপাতি পরিচালনা, মাননিয়ন্ত্রণ ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপনায়, পোশাকখাতের মার্চেন্ডাইজিং ও বায়িং হাউজেও অনেক বিদেশি কাজ করেন। বেপজার তথ্যমতে, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর কারিগরি ও পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার উচ্চপদগুলোতে বিদেশিরা কাজ করেন। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালক পদেও বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগ দেয়া হয়।
দেশের শিল্পগোষ্ঠীসমূহের তথ্য মোতাবেক, দেশের উচ্চশিক্ষিতদের ইংরেজি জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তারা হাতে-কলমে কিছু শেখেন না। সেখানে সাধারণ শিক্ষার পদ ও কারিগরি পদগুলোতে প্রার্থী সংখ্যায় অনেক বেশি পার্থক্য হয়।
আমাদের দেশে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের সংখ্যা বেশি। কারিগরি বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম। কারিগরির মধ্যে আবার উচ্চশিক্ষায় মেধাবীদের আগ্রহ বেশি। কিন্তু শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশে দক্ষ লোক দরকার মধ্যম পর্যায়ে। সেখানে মেধাবীদের যাওয়ার হার কম। উদ্যোক্তারা মনে করেন, দেশে এখন উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর সাধারণ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সীমিত করা দরকার বিপরীতে কারিগরি শিক্ষার দিকে ঝোঁক তৈরি করতে হবে।
বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রায় দুই কোটি নারী-পুরুষ এই খাতে কাজ করেন। তবে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মতে, করোনার কারণে পোশাক খাতের এক লাখের ও বেশি কর্মী কাজ হারিয়েছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস্) বলছে এই সংখ্যা আরো বেশি, তিন লাখের মতো।
আইএলও বলছে, করোনা মহামারীর কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেকার হয়েছেন।
পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে সিলেবাস থেকে ট্রেনিং সবকিছু। একাডেমিক লেভেলে এবং সিলেবাস মডারেট করা দরকার। দেশে মিড লেভেল ও টপ লেভেলের প্রফেশনালদের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে আসা কর্মীরা চাহিদা মেটাতে পারছে না। অনেকে মনে করেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী সরকারি চাকরি ও বিসিএসের স্বপ্ন দেখে, অন্য দেশের মানুষেরা সিইও এবং উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নে লেখাপড়া করে, পার্থক্য এই জায়গায়। তাছাড়া দক্ষতার অভাব নয়, অভাব মানসিকতার। ভালো লোকজন প্রাইভেট সেক্টরে আসতে চায় না। কারণ সামাজিক অবস্থা। বিয়ের বাজারে এক লাখ টাকা বেতন পাওয়া ছেলের চেয়ে সরকারি একজন ২০তম গ্রেডের মূল্য বেশি।
বিশেষ বিশেষ বৃত্তির ওপর নির্ভর করে যে সমাজ অতীতে গড়ে উঠেছিল, তার অস্তিত্ব আজকে নেই। সেই জন্য দরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কর্মমুখী শিক্ষা বা কারিগরি শিক্ষাগ্রহণ করে নিজে উদ্যোক্তা হতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তাদের পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তারা অনেক বেশি কর্মমুখী ও স্বনির্ভর। স্বল্প সময়ে চীন, জাপান কোরিয়া ও মালয়েশিয়াসহ যে সকল দেশ আজ প্রযুক্তির চরম শীর্ষে তাদের কারিগরি শিক্ষার গড় মোট শিক্ষিতের হারের শতকরা ৬০ ভাগের ওপর, যা আমাদের দেশে মাত্র শতকরা ১০ ভাগ।
আমাদের অর্থনীতি এখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। যার ফলে আমাদের কর্মমুখী শিক্ষার গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকহারে বাড়াতে হবে। বর্তমানে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য সরকার কিছুদিন আগে ভর্তির বয়সসীমা তুলে দিয়েছে, যা ইতিবাচক। এখন যে কোনো বয়সীরা চাইলে কারিগরিতে ডিপ্লোমায় ভর্তি হতে পারবে এবং নতুন করে দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১০ লাখ এবং নারী ৮ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার। তবে মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশই তরুণ ও কর্মক্ষম থাকার বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। আরো আশার কথা তাহলো দিনে দিনে বাড়ছে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা পৌঁছাবে ৭০ শতাংশে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার এই অগ্রগতির খবর প্রকাশিত হয়েছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রতিবেদনে।
এতে জনসংখ্যার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে, কর্মক্ষম জনশক্তিকে কাজে লাগানোর মতো উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভিন্নধর্মী কাজ কারিগরি দক্ষতা, সৃজনশীল জ্ঞান ও প্রশিক্ষণে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে।
আমরা চাই আরো শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তিবিষয়ক কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হোক আমাদের কারিগরি স্নাতকরা। কলোনিয়াল সময় শুধু আমাদের দাফতরিক কাজ করার মানসিকতা তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমরা এই মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে চাই।
নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে ২০২৪ সাল নাগাদ মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে ধাবমান বাংলাদেশ যা বাস্তবায়ন হবে ২০২৬ সাল নাগাদ।
নতুন এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে ব্যাপক পরিবর্তনের এবং নতুন বিশ্বের জন্য আমাদের তৈরি করার মানসিকতার বদল, মানসিক সক্ষমতা, দক্ষতামূলক শিক্ষা ও কারিগরি দক্ষতা যেগুলো নতুন অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য দরকার বলে আমি মনে করি।
Posted ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ জুন ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy