| মঙ্গলবার, ২২ মার্চ ২০২২ | প্রিন্ট | 585 বার পঠিত
যে কোন দেশের অর্থনীতির অন্যতম তিন খাত হচ্ছে ব্যাংক, বীমা এবং পুঁজিবাজার। আমাদের দেশে তৈরী পোষাকখাতের পরই বীমাখাত হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের খাত। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান অনেক অপ্রতুল। ব্যাংক, বীমা এবং পুঁজিবাজার আর্থিক খাতের এ তিনটির মধ্যে বীমাই সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। শুধু পিছিয়ে আছে বললেও কম বলা হবে, বরং বলা উচিত অর্থনীতির আকারের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে এ খাত। ২০১৯ সালে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল মাত্র দশমিক ৪৯ শতাংশ। ২০২০ সালে তা আরো কমে দশমিক ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে সুইস-রি ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত সিগমা রিপোর্ট। বীমা প্রিমিয়ামে বাংলাদেশের মাথাপিছু ব্যয় (কম-বেশি) ৯ মার্কিন ডলার, যা সারা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম নিম্ন। যথাযথ নীতি প্রণয়নের অভাবে খাতটি থেকে ভালো কিছু বের করে আনতে পারছে না বাংলাদেশের বীমা নীতিনির্ধারকগণ। করোনা মহামারীর কারণে ২০২১ সালে প্রিমিয়ামের হার আরো কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
করোনা মহামারীর কারণে দেশে বিভিন্ন খাতে কর্মহীন হয়েছে অসংখ্য কর্মক্ষম মানুষ। দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যা কর্মবাজারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয় বিদেশে। তবে করোনা মহামারীর কারণে দেশে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের কারণে সেটি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে বলে বিভিন্ন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক শ্র সংস্থা (আইএলও) এর তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারীতে বিশ্বে ৬ (ছয়) জনের ১ (এক) জন বেকার হয়েছে, আর বাংলাদেশে বেকার হয়েছে চারজন যুবকের মধ্যে একজন, যা প্রায় ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। করোনায় কর্মহীন জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। তার গবেষণায় দেখানো হয় দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছে সেবা খাতে।
অঞ্চল ও দেশ ভিত্তিক প্রিমিয়াম আয়, জিডিপিতে বীমার অবদান, বীমার ঘনত্ব, বীমা বাজারের প্রবণতা, সামষ্টিক অর্থনীতি সূচক ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাপী বীমা বাজারের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে সেই প্রতিবেদনে। বিশ্বের ১৪৭টি দেশের তথ্য পর্যালোচনা করা হলেও প্রতিবেদনটিতে স্থান পেয়েছে ৮৮তম দেশ হিসাবে। বাংলাদেশের বীমাবাজারের পরিসর তেমন বড় নয় সর্বসাকুল্যে প্রিমিয়াম আয় ১৩ হাজার ৮২১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। বিশ্বে বীমাশিল্পে আমাদের অবস্থান ৬৬তম। বলতে গেলে, বৈশ্বিক বীমাশিল্পের তুলনায় বাংলাদেশের বীমাশিল্প খুবই নগণ্য, দশমিক শূন্য তিন (০.০৩) শতাংশ মাত্র, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
২০ /১২/২০২০ ইং তারিখে এ সংক্রান্ত সার্কুলার নং- নন-লাইফ ৮২/২০২০ জারি করা হয়েছে এবং তৃতীয় পক্ষের ঝুঁকি বীমা তথা থার্ড পার্টি বীমা পরিকল্প বাতিল করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), যা সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি বলে অনেকেই মনে করছেন। অনেকেই মনে করত যে থার্ডপার্টি বীমা অর্থ হচ্ছে পুলিশের মামলা থেকে বাঁচার জন্য এই বীমা করতে হয়, আসলে কথাটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। দায়যুক্ত বীমাপত্রে (Act Liability) যে ঝুঁকিগুলো কভার করে থাকে তা হচ্ছে-মটর সড়ক অ্যাক্ট ১৯৮৩, প্রজ্ঞাপন আকারে জারী হয় ২০০১ সালে: ক) মৃত্যুঃ-২০,০০০.০০ টাকা, খ) গুরুতর আঘাতঃ-১০,০০০.০০ টাকা, ঘ) যে কোন আঘাতঃ- ৫,০০০.০০ টাকা, গ) সম্পত্তির ক্ষতিঃ-৫০,০০০.০০ টাকা। যা বর্তমান বাজারে একেবারেই বেমানান।
বিআরটিএর হিসাবে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৫ লাখ ২৩ হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৫৫৯টি মোটরসাইকেল, যা যানবাহনের মোট সংখ্যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। যদি মোটর বীমা (Comprehensive) করা যায় তবে শুধু মোটর সাইকেলেই প্রিমিয়াম আসবে (কম-বেশী) ৭৫৮,২৫,০০,০০০.০০ (শাতশত আটান্নো কোটি পঁচিশ লক্ষ) টাকা, ভ্যাট আসবে (কম-বেশী) ১১৩,৭৪,০০,০০০.০০ (এক শত তের কোটি ৭৪ লক্ষ) টাকা। অন্যদিকে যদি (মোটর সাইকেল বাদে) মোটরযান বীমা (ঈড়সঢ়ৎবযবহংরাব) করা যায় তবে প্রিমিয়াম আসবে (কম-বেশী) ৫,০০০,০০,০০,০০০.০০ (পাঁচ হাজার কোটি) টাকা এবং ভ্যাট আসবে (কম-বেশী) ৭৫০,০০,০০,০০০.০০ (সাত শত পঞ্চাশ কোটি) টাকা। বাংলাদেশে যদি বহুতল বভনগুলো বাধ্যতামূলক ভাবে বীমা করা হয় তবে ১ (এক) হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম বাড়বে অর্থাৎ সব মিলিয়ে বছরে শুধু নন-লাইফেই অতিরিক্ত (কম-বেশি) ৬ (ছয়) হাজার কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয় করা সম্ভব।
বীমা সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করতে হলে যা করণীয়:
১) জনগণের আস্থা ও সচেতনতা বাড়াতে;
২) স্ব-ইচ্ছায় কেউ নন-লাইফ বীমা করেনা তাই সেখানে বাধ্যবধকতা আরোপ করতে হবে যান-মাল নিরাপত্তার স্বার্থে;
৩) বীমার যে মৌলিক যে পার্থক্য রয়েছে তা দুর করতে হবে;
৪) তদারকির মাধ্যমে বীমা সেক্টরের দুর্নীতি শূন্যের কোঠায় আনতে হবে;
৫) আন্তর্জাতিক মানের বীমা পলিসিগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্যই দক্ষ আন্ডার রাইটদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে;
৬) নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বীমা কোম্পানির সু-সম্পর্ক থাকতে হবে;
৭) বীমাদাবি দ্রুত পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে;
৮) বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে;
৯) বীমা শিল্পে যথাযথ ট্রেনিং এর মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে;
১০) বীমার জটিলতার প্রশ্নে প্রয়োজনে ট্যেকনিক্যাল কমিটি গঠন করতে হবে;
১১) সঠিক পন্থা অবলম্বন করে অবৈধ কমিশন প্রথা বন্ধ করতে হবে;
১২) ইচ্ছাকৃত ভুল রেটিং প্রবনতা বন্ধ এবং অগ্নি বীমার ক্ষেত্রে ডিক্লিয়ারেশন পলিসি এবং প্যকেজ রেট বন্ধ করতে হবে;
১৩) যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা বাধ্যতামূলক ভাবে পরিপালন করতে হবে;
১৪) জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সম্মলিত ভাবে কাজ করতে হবে;
১৫) অভ্যন্তরিন পলিসিগুলোর Wording, সাথে অন্যান্য উপকরণ বাংলায় করতে পারলে ভালো হত;
১৬) SBC কে বাদ দিয়ে কোন বীমা কোম্পনি যেন বিদেশি জব-Re-Insurance প্রতিষ্ঠানে সরাসরি টাকা পাঠাতে না পারে;
১৭) Re-Insurance প্রতিষ্ঠান করার চেষ্টা করে দেশিও টাকা অথবা সম্পদ দেশে রাখার চেষ্টা করতে হবে;
১৮) বিভিন্ন বীমা প্রডাক্টের Country Limit কমপক্ষে দুই গুণ বাড়ানো যায় কিনা, সে চিন্তা করতে হবে;
১৯) বীমাদাবি নিষ্পত্তিতে কালক্ষেপন থেকে বিড়ত থাকতে হবে;
২০) IDRA এর কোন কর্তাব্যক্তি যেন কোন ক্রমেই কোন দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহন করতে না পারে;
২১) IDRAএর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বীমার উপর ৫০ শতাংশ অভিজ্ঞ লোক-বল নিয়োগ প্রদান করার ব্যবস্থা করতে হবে;
২২) Covid–১৯ এর কারণে যদি কেউ আক্রান্ত হয় অথবা মারা যার তার জন্য প্রনদনার ব্যবস্থা থাকতে হবে;
২৩) Covid-১৯ এর কারণে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে;
২৪) বীমাকর্মী যেন নিজেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করে অফিসে আসতে পারে, তার জন্য নিজস্বভাবে গাড়ীর ব্যবস্থা করতে হবে;
২৫) প্রকাশ্যে অথবা গোপনে অনৈতিক কমিশন প্রথা বন্ধ করতে হবে;
২৬) মূখ্য নির্বাহীদের বীমার উপর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান থাকতে হবে;
২৭) উন্নত বিশ্বের ন্যায় বাধ্যতামূলক মটর বীমা চালু করতে হবে এবং নতুন নতুন প্রডাক্ট খুঁজে বেড় করতে হবে;
২৮) মোটর Comprehensive বীমা বাধ্যতামূলক ভাবে চালু হলে প্রিমিয়াম বহুগুন বেড়ে যাবে;
২৯) বিভিন্ন কারণে ট্যারিফ রেট কমে যাওয়ায় প্রিমিয়াম কমে গেছে, ট্যারিফগুলো আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে;
৩০) ব্যাংকের যোগ সাজশে বাধ্যতামূলক বীমার ব্যবাহার যাতে কমে না যায়, সে দিকে খোয়াল রাখতে হবে;
৩১) বীমা ক্ষেত্রটি যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেই বার্তাটি গ্রাহককের কাছে সফল ভাবে পৌঁছাতে হবে;
৩২) IDRA এর উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের বীমার উপর অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে হবে;
৩৩) জীবন বীমার ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে যথাযথ ভাবে টাকা প্রদানের ক্ষেত্রে কালক্ষেপন করা চলবে না;
৩৪) জীবন বীমার পলিসির অর্ধেকের বেশি তামাদি যাতে না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে;
৩৫) পলিসি তামাদি হলে সে ক্ষেত্রে বীমার টাকা সহজে ফেরত পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে;
৩৬) বীমা কোম্পানিগুলো দক্ষ মানব সম্পদ গড়তে কোম্পানির কর্তৃপক্ষের অনিহা দুর করতে হবে;
৩৭) সার্ভে করার ক্ষেত্রে সার্কুলার অনুযায়ী যথাযথ সার্ভে ব্যবস্থার বাধ্যবধকতা নিশ্চিত করতে হবে;
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এখন পর্যন্ত অভিন্ন বেতন কাঠামো, সার্ভিস রুল, নিয়োগ এবং প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া, সমস্ত বীমা কর্মীদের গ্রুপ বীমার আওতায় আনা, চাকরির সময়সীমা, পদ্দোন্নতি ইত্যাদির নিয়ন কানুন এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ ঠিক করতে পারে নাই। যার পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত মেধাবীরা বীমা সেক্টরে আসতে চায় না। তবে আশা করা হচ্ছে উপরোক্ত কারণ চিহ্নিত করণের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করলে বীমা সেক্টর বাংলাদেশ জাতীয় জিডিপিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
মো. মানসুর আলম সিকদার
ভিপি, প্রধান (অবলিখন এবং বিসিডি);
রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স কো. লি.
Posted ২:৪০ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ মার্চ ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy