শুক্রবার ১৮ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২ কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানিলন্ডারিং অর্থনীতির এক দুষ্টক্ষত

পান্না কুমার রায় রজত   |   রবিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২১   |   প্রিন্ট   |   709 বার পঠিত

মানিলন্ডারিং অর্থনীতির এক দুষ্টক্ষত

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের কত টাকা জমা আছে তার একটি ধারণা প্রতি বছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। ২০২০ সালের রিপোর্টে প্রকাশিত ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ২০১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিরা জমা করেছেন। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি এই তথ্য প্রকাশ করে। যদিও সেখানে গ্রাহকের বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। স্ইুজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয় বা টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না। এই গোপনীয়তা নীতির কারণে সারা বিশে^র ধনী ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন। কিন্তু বাংলাদেশি এই ধনকুবেরা কীভাবে সেই অর্থ সুইস ব্যাংকে পাঠান তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হুন্ডি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালেই এই অর্থ পাচার হচ্ছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সাথে সাথে অর্থ সন্ত্রাসের মাত্রাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উন্নত ও অনুন্নত সব দেশই অর্থ সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। অধিকাংশ দেশেই অর্থের অবৈধ লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং একইসাথে অবৈধ অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন অন্যায় কার্যক্রমে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ-সম্পদের সামাজিকভাবে বৈধতা দেয়ার উদ্দেশ্যে উক্ত অর্থের উৎস গোপন করার জন্য মানুষ বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়। অবৈধ অর্থের উৎস গোপনকরণের মাধ্যমে সম্পদের বৈধতা দেয়ার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকেই মানিলন্ডারিং হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শুধু বিদেশে টাকা কিংবা সম্পদ পাচারের মাধ্যমে লন্ডারিং করা হয়ে থাকে ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। বরং এটি মানিলন্ডারিং করার একটি উপায় মাত্র। দেশের অর্থনৈতিক গণ্ডির ভিতরে রেখেও অবৈধ সম্পদকে বৈধ করা যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে ‘ডমেস্টিক লন্ডারিং’। মূলত তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে মানিলন্ডারিং। যে তিনটি ধাপ পার করতে হয় তাকে বলে Stage of Money Laundering অবৈধ অর্থ কিংবা সম্পদকে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ঢুকানোর মাধ্যমে শুরু হয় মানিলন্ডারিং। এটি হতে পারে ভূয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কিংবা ডিপোজিটের মাধ্যমে ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা রাখার মাধ্যমে, অর্থনীতির পরিভাষায় এই ধাপটি পরিচিত ‘Placement’ নামে। এরপর শুরু হয় লেনদেন। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে অর্থ যদি ব্যাংকে ‘প্লেসমেন্ট’ করা হয় তা একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ক্রমান্বয়ে শত শত ভুয়া অ্যাকাউন্টে লেনদেন শুরু করা হয়। এই ধাপকে বলা হয় Layering’ আর শেষ ধাপ পরিচিত ‘Integration’ বা সমন্বয়করণ নামে। অর্থাৎ এই ধাপে পুরো অবৈধ সম্পদটিকে বৈধভাবে বিনিয়োগ করা হয়। ফলে অবৈধভাবে আয়ের মাধ্যমে অর্জিত টাকাকে শনাক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদিও মানিলন্ডারিংকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু সবসময় যে এই তিন ধাপে ব্যাপারটি ঘটে এমন নয়। ইলেকট্রনিক মানি, অফশোর ব্যাংকিং, ডার্ক ওয়েবের কারণে মানিলন্ডারিং প্রক্রিয়াটি আরো জটিল হয়ে উঠেছে।

আমরা যখন কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয় করি তার একটি প্রমাণপত্র আমাদের দেওয়া হয়। এই প্রমাণপত্রে পণ্যটির দাম, ক্রয়ের তারিখ এরকম তথ্যাদির উল্লেখ থাকে। এটিকে বলা হয় ইনভয়েস কিংবা পণ্য ক্রয়ের স্মারক। ইনভয়েসকে কাটাছেঁড়া করে মানিলন্ডারিং প্রক্রিয়াকে আবার ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং করা হয়। ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কোনো একটি পণ্যকে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামের ইনভয়েসিং কিংবা চালানপত্র বানিয়ে অন্য দেশে পণ্য রফতানি করা হয়। ফলে আমদানিকারক পণ্যের মূল্য হিসেবে খুব সহজেই বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্য দেশে থাকা রফতানিকারকদের কাছে চোরাচালান করে দিতে পারেন। আর যে কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য এই প্রক্রিয়াটিকে অনুসরণ করে চোরাচালানকারীকে ধরা কঠিন। পাশাপাশি ভুয়া চালানপত্র তৈরি করে খুবই সাধারণ মালামাল আমদানি-রফতানি করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে দেয় সন্ত্রাসী চক্র। আর আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করার সাথে সাথে অর্থের উৎস খুঁজে বের করা আরো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ে ঠিক উল্টো কাজটি করা হয়ে থাকে। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক দামে পণ্য রফতানি করে দেওয়া হয়। ফলে পণ্যের বাজারমূল্য বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমদানিকারকের কাছে পৌঁছে যায়।

প্রতি বছর কত টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয় সেই সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য কোথাও নেই। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র মোতাবেক, সম্প্রতি কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পেয়েছে সরকার। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের যেসব ঘটনা আদালতে আসছে সেগুলো সিন্ধুতে বিন্দুর মতো অর্থাৎ বেশিরভাগ ঘটনা কেউ জানেই না।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার কয়েকভাবে হয়ে থাকে। এর বড় উপায় হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কারসাজি আর অন্যটি হচ্ছে হুন্ডি। বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে যখন কোনো পণ্য আমদানি করা হয়, তখন কম দামের পণ্যকে বেশি দাম দেখানো হয়, ফলে অতিরিক্ত অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়। একইভাবে রফতানির ক্ষেত্রে বেশি দামের পণ্যকে কম দাম দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ দেশে আনা হয় না। টাকা পাচারের পুরো বিষয়টি যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে, সে জন্য সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় না। সহজ পদ্ধতি হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো। অর্থ পাচারের বিষয়গুলো নজরদারির জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি ইউনিট গঠন করেছে অনেক আগেই। এর নাম ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণের সময় একজন ব্যক্তি প্রতিবছর ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া এডুকেশন এবং ট্রিটমেন্টের জন্য শর্তসাপেক্ষ অর্থ নেয়া যায়। তবে বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেয়া নিষিদ্ধ। তাহলে অনেক বাংলাদেশি কানাডায় বাড়ি কিনেছেন কীভাবে? সূত্র মোতাবেক কানাডায় যে কোনো ব্যক্তি বাড়ি ক্রয় করতে পারেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কানাডার নাগরিক না হলেও কোনো সমস্যা নেই। কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন না তাদের বাড়ির ক্রয়মূল্যের উপর ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হয়। যারা পুরোপুরি নগদ টাকা দিয়ে বাড়ি ক্রয় করেন, তাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। অভিযোগ রয়েছে, অনেক ব্যবসায়ী যে রফতানি করেন সেখান থেকে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশের ব্যাংকে রাখেন। সে টাকা বাংলাদেশে আসছে না।

একটি দেশ থেকে টাকা তখনই পাচার হয় যখন সেখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগ আস্থা কম থাকে।
বিদেশে অর্থ পাচার হলে দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশের বাইরে যখন টাকা পাচার হয় তখন কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম বেড়ে যায় এবং দেশের মুদ্রা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। যে টাকাটা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেটা দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। যদি দেশে বিনিয়োগ হতো তাহলে কর্মসংস্থান বাড়তো। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম মানিলন্ডারিং আইন প্রণয়ন করেছে। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০০২ (আইন নং-৭,২০০২) প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে উক্ত আইন বাতিল করে ২০০৮ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ অধ্যাদেশ হিসেবে প্রবর্তন করা হয়।

মানিলন্ডারিং দেশের অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থার গুরুতর ক্ষতিসাধন করে। অপরাধীরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দ্বারা অবৈধভাবে আহরিত অর্থ মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বৈধ করার প্রয়াস পায় অর্থাৎ নেপথ্যে অন্য অপরাধ সংঘটিত হয়। এ জাতীয় অপরাধ থেকে অর্জিত অর্থ দ্বারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি জাতীয় ও বিশ^ অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হয়ে ভারত, চীন, মালয়েশিয়ার মতো এলডিসি নয় এমন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে। বাংলাদেশ এখন বিশে^ দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপি আকার বিবেচনায় বিশে^ ৪১তম। গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ নেমে এসেছে।

অর্থনীতির গতিশীল ধারা বজায় রাখা এবং জিডিপি ও সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধিসহ মানিলন্ডারিং নামক দুষ্টক্ষত প্রতিরোধ করার মানসিকতা জাতি হিসেবে আমাদেরই ভূমিকা নিতে হবে।

 

Facebook Comments Box
top-1
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});

Posted ৬:৪৭ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২১

bankbimaarthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ ক্যালেন্ডার

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
প্রধান সম্পাদক: মোহাম্মাদ মুনীরুজ্জামান
নিউজরুম:

মোবাইল: ০১৭১৫-০৭৬৫৯০, ০১৮৪২-০১২১৫১

ফোন: ০২-৮৩০০৭৭৩-৫, ই-মেইল: bankbima1@gmail.com

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।