পান্না কুমার রায় রজত | বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট ২০২৩ | প্রিন্ট | 244 বার পঠিত
আয় কম ব্যয় বেশি। কঠিন চাপে অর্থনীতি। এমন এক কঠিন বাস্তবতার মধ্যে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণীত হয়েছে। প্রতি বছরই বাজেটের আগে খুব বেশি আলোচনা হয় কালোটাকা নিয়ে। কর আইনে বা অন্য কোনো আইনে কালোটাকার কোনো সংজ্ঞা নেই। নেই মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনেও। তবু ও কালোটাকার একটা প্রচলিত ধারণা আছে। কর আইনে কালোটাকার সংজ্ঞা না থাকলেও ‘অপ্রদর্শিত আয়’ কথাটার উল্লেখ আছে। সে আইন অনুযায়ী অপ্রদর্শিত আয়ই কালোটাকা বলে অভিহিত। অর্থাৎ যে আয় করদাতা কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করেনি তা কালোটাকা বলে ধরে নেয়া হয়। অপ্রদর্শিত আয় আবার দু’ রকমের হয়। যে আয় বৈধ উপায়ে অর্জিত হয়েছে কিন্তু আয়কর দেওয়া হয়নি এবং যে আয় নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্জিত হয়েছে তার উপর আয়কর দেওয়া হয়নি। কিন্তু কালোটাকার উৎস নিশ্চিতভাবেই অবৈধ। তাই বৈধ অপ্রদর্শিত অর্থের সঙ্গে কালোটাকাকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।
নির্দিষ্ট পরিমাণ কর এবং জরিমানা প্রদান সাপেক্ষে কালোটাকাকে মূলধারার অর্থনীতির ভেতর অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করা হয় যাকে প্রচলিত ভাষায় কালোটাকা সাদা করা বলা হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ২০-(২) works as a right and duty অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে The state shall endeavour to create conditions in which, as a general principle, persons shall not be able to enjoy unearned incomes, and in which human labour in every form, intellectual and physical, shall become a fuller expression of creative, endeavour and of the human personality. তবু বাজেট প্রণয়নের সময় বিশেষ আইনি প্রক্রিয়ায় কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থা রাখা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসেবে স্বাধীনতার পর থেকে দেশে ঘোষণা দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে ২১ বার। আর ব্যতিক্রমী সময় ছিল ২০২০-২০২১ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অর্থ বৈধ হয় এ সময়ে। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা মূলধারার অর্থনীতিতে আনতে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ১ জুলাই, ২০২০ থেকে ৩০ জুন, ২০২১ পর্যন্ত। ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত অর্থ জমি বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র শেয়ার, বন্ড বা অন্যকোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্ন প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না। অর্থাৎ এনবিআর, দুদকসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের তদন্ত করতে বা আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে না। বিশেষ এ সুবিধা নিয়ে এ দেশের অনেক ব্যবসায়ী বর্তমান এবং সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, শিল্পী, খেলোয়াড়সহ অনেকে কালোটাকা সাদা করেছেন। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১১ হাজার ৮৫৯ ব্যক্তি ২০ হাজার ৬৫০ কোটি কালোটাকা সাদা করেছেন। এতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১ হাজার ৬৬৩ কোটি কালোটাকা বৈধ হয়েছে। এর মাধ্যমে ১১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা কর আয় হয়েছে সরকারের। আর গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিনা প্রশ্নে পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই উদ্যোগে কোনো সাড়া মেলেনি। অর্থাৎ দেশে টাকা ফেরত এনে কেউ পাচারকারী তালিকায় নাম উঠাতে চায়নি। তবে চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার এই বিশেষ সুযোগ রাখা হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাজেটে কেনই বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়? তাদের যুক্তিগুলোর অন্যতম হচ্ছে দেশে বিপুল অঙ্কের কালোটাকা রয়েছে, এই টাকা অর্থনীতির মূল ধারার মধ্যে না আনতে পারলে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হবে। ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। আর, পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের ধারণা এর ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে দেশের পুঁজিবাজার। তাই দেশের অর্থনীতিকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে হলে এ সুযোগ রাখা প্রয়োজন। যেমন শেয়ারবাজার, বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিতে বিনিয়োগ ইত্যাদিতে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছিল।
এবার আসা যাক শেয়ার বাজার বিষয়ে। বৃহৎ পরিসরে দেখলে পুঁজিবাজার শক্তিশালী করার জন্য সুযোগ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ পুঁজিবাজার শক্তিশালী থাকলে সাধারণ মানুষ তাদের ছোট ছোট সঞ্চয় বাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়। এই ছোট সঞ্চয়গুলোই মেধাবী উদ্যোক্তাদের হাতে বড় পুঁজি হয়ে জমা হয়। উদ্যোক্তাগণ এই পুঁজি দিয়ে নিজেদের বড় বড় পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ পায়। সবচেয়ে বেশি সুবিধা পান যেসব উদ্যোক্তা যাদের বড় বিনিয়োগ করার ক্ষমতা নেই। পুঁজিবাজার চাঙ্গা রাখার মন্ত্রটা এখানে। বাস্তবে বাংলাদেশে এমন আদর্শিক অবস্থা বিরাজ করে না। এখানে পুঁজিবাজার শেয়ার ইস্যু করে সবচেয়ে বড় করপোরেট হাউজগুলো। এদের প্রধান উদ্দেশ্য বাজার থেকে পুঁজি আহরণ নয়, বরং কম হারে কর প্রদান করা এবং নিজেদের বিনিয়োগের বাজার দর বাড়ানো। এরা অত্যন্ত বড় মাপের পুঁজিপতি। শেয়ারবাজারে কালোটাকা ঢুকলে তাদের পুঁজির অংকই শুধু বাড়বে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভাগে পড়ে সামান্যই। কিছু নামসর্বস্ব কোম্পানি আছে যারা বাজারে শেয়ার ছাড়ে ভিন্ন উদ্দেশ্যে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে বাজার থেকে পুঁজি আহরণ করে কেটে পড়া। কালোটাকা তাদের কোম্পানিতে ঢুকলে একদল অসাধু লোকের টাকা অন্য অসাধু লোকের পকেটে ঢুকে। অর্থাৎ টাকার হাত বদল হয় মাত্র।
আরেকটি জায়গা হচ্ছে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাট খাতে বিনিয়োগ। স্থাবর সম্পত্তিতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতিতে কালোটাকা অন্তর্ভুক্ত করা যায় ঠিক। স্থাবর সম্পত্তিতে বিনিয়োগ হলে নির্মাণ শিল্প গতিশীল হয়, শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। তারপর ও এর একটা পাশর্^প্রতিক্রিয়া আছে। কালোটাকা বিনিয়োগের ফলে স্থাবর সম্পত্তির বাজার দর বেড়ে যায় ফলে স্বাভাবিক উপায়ে উপার্জিত লোকদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না, দামের বেলুন তৈরি হয়।
নানা কারণে বৈধ অর্থ ও অপ্রদর্শিত থেকে যেতে পারে, এটি যেমন ইচ্ছাকৃত হতে পারে, তেমনই আবার আইনি জটিলতার কারণেও হতে পারে। ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ী কর ফাঁকি দেয়ার অসাধু উদ্দেশ্যথেকে তার বার্ষিক আয়ের একটা অংশ চেপে গেছেন। আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করেননি। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ না করা অর্থ অপ্রদর্শিত অর্থ। আবার একজন ব্যক্তি হয়তো উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অথবা আগে কিনে রাখা এক খণ্ড জমি বিক্রি করেছেন। কিন্তু আইনি জটিলতায় পুরো অর্থ আয়কর বিবরণীতে দেখাতে পারেননি। কারণ ভূমি অধিদপ্তর বিভিন্ন এলাকায় জমির একটি দর নির্ধারণ করে দিয়ে থাকে। তাই চাইলেও জমি বিক্রির দলিলে তার বেশি মূল্য উল্লেখ করা যায় না। তাই প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য উল্লেখ করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিক্রয় মূল্যের বাকি অংশ আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করা যায় না। এভাবে বৈধ পথে উপার্জিত টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যায়।
বিভিন্ন পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসক-প্রকৌশলী, শিক্ষক কিংবা অনেক পেশার চাকরির বাইরে ও পেশাগত চর্চার মাধ্যমে অর্থ আয় করে থাকে। যেমন- চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, এখন কোনো চিকিৎসক যদি এ থেকে পাওয়া অর্থ আয়কর রিটার্নে না দেখান তাহলে সেটি কালোটাকায় পরিণত হয়। নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা কালোবাজারি, চোরাকারবারি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার বাজার বেশ বড়। এসব কাজে জড়িত অর্থ পুরোটাই কালোটাকা। কারণ এগুলো বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে নিষিদ্ধ। এই আয় আয়কর বিবরণীতে উল্লেখের কোনো সুযোগ নেই। আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি রফতানির ক্ষেত্রে কাগজপত্রে অনিয়ম করে দাম বেশি বা কম দেখিয়ে করের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। এর মাধ্যমে যে অর্থ সরানো হয় সেটিই কালোটাকা। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি পেশাজীবীরা তারা যা আয় করে তা কাগজপত্রে সম্পূর্ণটা দেখায় না। ফলে তারা যে ঘোষণা দেয়সেটি তাদের আয়ের চেয়ে অনেক কম ফলে এখানেও কালোটাকা তৈরি হয়।
আয়কর আইনে একটি স্থায়ী ধারা আছে, যে ধারায় অপ্রদর্শিত অর্থবা কালোটাকা বিধি মোতাবেক কর দিয়ে বৈধ করা যায়। তা সত্ত্বেও কেন বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিতে হয়? প্রসঙ্গত বিদ্যমান আয়কর আইনে একটি স্থায়ী ধারা (১৯ ধারা) আছে, যে কোনো সময়ে নির্ধারিত করের (উচ্চকর) পাশাপাশি জরিমানা হিসেবে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) প্রদর্শন করা যাবে। এটা অতীতে ছিল বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে এই ধারা যতদিন বিলুপ্ত না হবে ততদিন থাকবে। এ ধারা অনুযায়ী উচ্চ হারে কর দিয়ে ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে। তবে রাজস্ব আইনের বিধান অনুযায়ী বিনিয়োগকারীর অর্থের উৎস নিয়ে এনবিআর কিছু না বললেও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারের যে কোন সংস্থা জবাবদিহিতায় আনতে পারবে। হয়তো আইনি জেরার মুখে পড়ার ভয়ে অনেকে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার আগ্রহী হয় না।
তাই অপ্রদর্শিত আয় বা কালোটাকা যথাযথ বিধি মেনে প্রদর্শন করলে বাংলাদেশের মূল অর্থনীতি গতিশীল হবে। আয়কর বা রাজস্ব আহরণ হবে এবং বড় বড় উদ্যোক্তাগণের বিদেশমুখী বিনিয়োগ করার প্রবণতা কমে যাবে বলে আমি মনে করি।
Posted ৮:০৮ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy