পান্না কুমার রায় রজত | সোমবার, ১৬ আগস্ট ২০২১ | প্রিন্ট | 470 বার পঠিত
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালিত হয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য। মানুষ কাজ করবে, আয়-উপার্জন করবে, তা থেকে ব্যয় করবে। এই ব্যয় আবার কারো আয় হিসাবে যাবে। পাশাপাশি আয়ের কিছু অংশ সঞ্চয় হিসাবে রক্ষিত হয়। সেটি বিনিয়োগ হবে। বিনিয়োগ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়াবে। এভাবে অর্থনৈতিক চক্র পরিচালিত হয়। আর এভাবে সম্পদের পরিমাণ বাড়ে।
সহজ ভাষায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলো দেশে মোট সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। তবে শুধু সম্পদ বাড়লেই হয় না, সম্পদ কার মালিকানায় যাচ্ছে এবং বিশেষ কিছু ব্যক্তির কাছে সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে কি-না সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা সম্পদের বণ্টন। এই বণ্টন হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। যে যার অবস্থান থেকে কাজ করে আয়-উপার্জন করে সম্পদ গড়ছে। এটা হলো এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় বণ্টন। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র করারোপের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ করে এবং তা বিভিন্ন কাজে ব্যয় করে। এটা বণ্টনের আরেকটা ধাপ। প্রবৃদ্ধি হলেই সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকরা সমভাবে বা ন্যায্যভাবে সবসময় সম্পদের অংশীদার হয় না বা হতে পারে না। সে জন্যই রাষ্ট্র কর্তৃক কিছু ব্যবস্থা থাকে বণ্টনকার্য সম্পাদনের জন্য, যেন পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী তার মৌলিক অধিকারটুকু পায়, জীবনমান উন্নত করতে সহায়তা পায়।
এক বিশেষ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা এখন অতিবাহিত হচ্ছি। শহরের ভিতরে ও প্রান্তে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন শহর, পুরোনো ঘরবাড়ি ভেঙে গড়ে উঠছে হাইরাইজ বিল্ডিং, অত্যাধুনিক সুইমিংপুল, হেলথ ক্লাব, সনাতন মুদি দোকানের জায়গায় মাল্টিস্টোরিড শপিং কমপ্লেক্স, পুরোনো থিয়েটার পাড়ার বদলে মাল্টিপ্লেক্স, গ্রামগুলো বিদ্যুতের আলোতে ঝলমল করছে। অধিক রাত্র পর্যন্ত গ্রামের বাজারে লেনদেন বেচাকেনা চলছে। এসি বাস, হাইওয়ে রোডে চলাচল করছে। ঝলমলে বিপণিবিতানে কেনাকাটা, ফ্রাইড চিকেন, পিজা আর বার্গার খাওয়া, সুসজ্জিত হোটেলÑআশপাশে তাকালে এই চিত্রগুলো সহজেই দৃশ্যমান হয়, তখনই বোঝা যায় আর্থিক উন্নতির চিত্রটা।
তবে এটাই প্রবৃদ্ধির পূর্ণাঙ্গ চিত্র নয়। যে ঢাকা শহরে প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়ি রাজপথে নামছে, সেই ঢাকা শহরেই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সকাল-বিকাল লক্কড়-ঝক্কড় বাসে চড়ে, চ্যাপ্টা হয়ে যাতায়াত করছে। প্রতিদিন হাজার হাজার কিশোরী সারিবেঁধে পোশাক কারখানার কাজে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে যাচ্ছে। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার যাদের কাছে আকাশের চাঁদের মতোই অধরা। প্রবৃদ্ধির সুফল যে সীমিত মানুষের হাতে আটকে যাচ্ছে, এগুলো তারই খণ্ডিত প্রতিচিত্র। আর এই আটকে যাওয়া যত বাড়ছে, তত বড় হচ্ছে আয় বৈষম্য।
অর্থনৈতিক উদারনীতি বা মুক্ত অর্থনীতির চিন্তা মূলত ব্যক্তিস্বাধীনতা, মনন, মানসিকতা ও চেতনা থেকেই উদ্ভূত। এ চেতনা থেকেই দেশে দেশে সাধিত হয়েছে অর্থনৈতিক সংস্কার। মুক্তবাজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে গরিব মানুষের স্বার্থরক্ষা হয় না। সংকটকালীন মুনাফা অর্জন থেকে লোভী ব্যবসায়ীদের নিবৃত্ত করা যায় না। এ জন্য দরকার হয় হস্তক্ষেপ, প্রয়োজন পড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের। কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা এই সত্যটিকে মেনে নিতে চায় না।
পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে একাত্তরের ২৬ মার্চ যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, দীর্ঘ ৯ মাস পর ৫০ বছর আগের এই দিনে সেই রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে মিলেছিল চূড়ান্ত বিজয়। সেই বিজয়ের জন্য ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগে জাতিকে দিয়েছিল সার্বভৌমত্ব, নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়। কেবল রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিলাভ ও ছিল সেই মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম অনুপ্রেরণা। কারণ সুজলা-সুফলা এই ভূখণ্ডকে অর্থনৈতিকভাবে চূড়ান্তভাবে শোষণ করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তাতে করে এদেশের মানুষের রক্ত-ঘামে যা কিছু অর্থনৈতিক অর্জন ছিল, তার সবই ভোগ করতো সেই শোষকগোষ্ঠী। এই জনপদের মানুষের প্রাপ্তি ছিল কেবলই অর্থনৈতিক বৈষম্য আর বঞ্চনা। তাই ১৯৪৭ সালের পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম, তা কেবল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার লড়াই নয়, ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামও। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর সেই বাংলাদেশ ৫০ বছরে পাহাড়সম নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে উন্নয়নের মহাসড়কে স্থান করে নেয়া এক বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। এই পাঁচ দশকে দারিদ্র্যবিমোচন, মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অর্থনৈতিক প্রায় প্রতিটি খাতেই অগ্রগতি লাভ করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট উত্থাপিত হয় মহান জাতীয় সংসদে। সেই বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। ৫০ বছর পেরিয়ে এসে চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭৬৮ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে।
৫ আগস্ট ২০২১ বিবিএস তথ্যানুসারে, দেশের মানুষের বর্তমান মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নামে বিশে^ পরিচিতি দিয়েছে পোশাকখাত। শুধু তাই নয় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মাসেতু পর্যন্ত নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। মেট্রোরেল, অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণে বিপুল কর্মকাণ্ড দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুপারিশ করেছে। ১৭ জুন ২০২১ দিনশেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৪৬ কোটি (৪৫.৪৬ বিলিয়ন) ডলার। ২০২১ সাল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর।
সেই সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ উপাধি পাওয়া দেশটি আজ ৫০ বছরে উন্নয়নের রোল মডেল। ৯৬ বছর বয়সী কিসিঞ্জার ২০১৯ সালের নভেম্বরে চীন সফর করেন। কারণ এখনো তার আরাধ্য চীন-মার্কিন সম্পর্কোন্নয়ন। অথচ এই এশিয়ার আর এক দেশ কিসিঞ্জারের শত বাধা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তখন থেকেই বাংলাদেশ তার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর কৌতুকের বিষয় ছিল। এদের কুশিলবী ষড়যন্ত্র ছিল দুর্দান্ত। বাংলাদেশের ইতিহাস ও কিসিঞ্জারকে স্মরণ করবে তার হঠকারী ভূমিকার জন্য।
ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। এদেশের মালিকানায় রয়েছে বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব। এই ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন।
কোভিড-১৯ মহামারী বিশে^র মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এ মহামারীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে একীভূত হওয়ায় রফতানি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি যথেষ্ট ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমান অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশে^র ২৫তম বৃহৎ শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল-২০২১’ নামের ওই প্রতিবেদনটি গত ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ প্রকাশ হয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ও ৫০তম বাজেটে আমরা আমাদের অর্জনকে সুসংহত এবং টেকসই করার জন্য যে ঊর্ধ্বগামী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তার সুফল সব মানুষ যেন সমানভাবে পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশের জনগণের কাক্সিক্ষত সাফল্য হাতে ধরা দেবে।
Posted ৪:১১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৬ আগস্ট ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy