মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ | রবিবার, ০৬ জুন ২০২১ | প্রিন্ট | 606 বার পঠিত
১১-১২ বছরের ছোট্ট এক কিশোর ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ খদ্দরের লাল মুজিব কোট পরে রেসকোর্স ময়দানে আকাশ-সমান যার উচ্চতা, সেই বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে গিয়ে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছেলেটি বাঁশের লাঠি ট্রেনিং, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খবরাখবর সংগ্রহ করতে করতে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে নিজেকে বিজয়ের নায়ক মনে করে। যুদ্ধ-পরবর্তীতে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে উপস্থিত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করেছে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘জুলিও কুরি পুরস্কার’ নেয়ার কথা আর আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পরীক্ষা অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর নির্র্মম শাহাদাতবরণ আমার কিশোর মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে।
ছোটবেলা থেকেই সে মহীরুহ-সমান মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমার রক্ত কণিকায় প্রতিনিয়ত অনুরণিত হতে থাকে। দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পর কালের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতীক হয়ে ১৯৮৬ সাল থেকে বীমাশিল্পের সাথে জড়িত হই। দীর্ঘ ২৮ বছর এই সেক্টরের সকল শাখায় কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ২০১৩ সাল থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও হিসেবে কর্মরত থেকে নন-লাইফ বীমার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রায় ৭ বছর ধরে লিখে চলেছি। যদি আমার লেখনী এই শিল্পের জন্য সামান্যতম ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করতে পারে, সেটাই বঙ্গবন্ধুর একজন কর্মী হিসেবে আমার সার্থকতা।
বীমা একটি সর্বজনীন বিষয়। ব্যক্তি এবং সম্পদের নিরাপত্তার জন্যই বীমার জন্ম। তাই বীমাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। মানবজাতির জীবন এবং তাঁর সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করাই বীমার কাজ। অগ্নিকাণ্ডে রাজধানী শহর ঢাকার নিমতলী, বনানীর এফআর টাওয়ার, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের বা তাজরিন অ্যাপারেলস ইত্যাদির অগ্নি-দুর্ঘটনার কথা কি আমরা ভুলে যেতে পারি? সেখানে সম্পদের পাশাপাশি কতশত লোক আহত ও নিহত হয়েছেন। আর কত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা আজো আমাদের অজানা। ছোট একটি দুর্ঘটনা যে কোনো একটি বীমা কোম্পানিকে পঙ্গু করে দিতে যথেষ্ট। সেদিকে দৃষ্টি রেখেই স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সাথে অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থেকে বীমা ব্যবসা চালিয়ে যেতে হবে।
আমাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা বাস্তবায়নে বীমাশিল্পকে বেছে নিয়েছিলেন আর সেখান থেকেই একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছিলেন। তাই স্বাধীনতার পর এই বীমাশিল্পকে ঢেলে সাজানোর জন্য কতই না চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কিছু অতিলোভী এবং দুষ্ট প্রকৃতির ব্যক্তিরা বারবার তাতে বাধার সৃষ্টি করেছেন। পাট ও তুলার গুদামে আগুন লাগিয়ে বীমা ব্যবসাকে অস্থির করে তোলে এবং দেশের অর্থনীতির গতিকে রুদ্ধ করার চেষ্টা করে।
পরবর্তীতে এরশাদ সাহেবের হাত ধরে আশির দশকে বেসরকারি খাতে বীমাশিল্পের গোড়াপত্তন ঘটে। রাজনৈতিক ইচ্ছায় বীমাশিল্পের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে নন-লাইফ বীমার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫টি, যা আমাদের দেশের অর্থনীতির পরিসরে এসব সুন্দরভাবে টিকে থাকা অত্যন্ত দুষ্কর। আর তাই অস্তিত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকতে অনেকেই নীতি-নৈতিকতার কথা ভুলে যান। যারা রাজনীতির বড় পৃষ্ঠপোষক, তাদের কোম্পানির দ্বারাই বীমাশিল্প বর্তমান বাজারে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। তাঁরা অ্যাসোসিয়েশনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে নিজেদের লাভের আশায় শিল্পকে কলুষিত করছেন। এই কাজে কিছুসংখ্যক সিইও জড়িত রয়েছেন। গুটিকয়েক কোম্পানির জন্য বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের বীমাশিল্পের পরিচ্ছন্নতার জন্য ইস্যুকৃত ৬৪, ৭৫ এবং ৮৪নং সার্কুলার বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্কুলার নং-৮৪ এর ৩নং ধারায় উন্নয়ন কর্মকর্তা, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এদের জন্য পারিশ্রমিকের কোনো হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। পারিশ্রমিকের হার নির্ধারিত না থাকার কারণে কিছু লোভী ও দুষ্ট লোক মার্কেটে নতুন করে অস্থিরতা শুরু করেছে। এই অস্থিরতা রোধে বিআইএ এবং আইডিআরএকে সম্মিলিতভাবে পারিশ্রমিকের একটি হার অবশ্যই নির্ধারণ করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের মহৎ উদ্যোগ যার ব্যবসা সে করবে। এই ব্যাপারে বারবার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কয়েকটি কোম্পানির জন্য বাস্তবায়িত হচ্ছে নাসিদ্ধান্তের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ায় ছোট কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা হারিয়েছে আবার আবেদন নিবেদন করেও ক্ষেত্রভেদে কোনো প্রতিকার না পাওয়ার কারণে অনেক বীমা কোম্পানির শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনেকে চাকরি হারিয়ে আজ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ অযোগ্যরা সময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে ঠিকই কোম্পানিতে বহাল তবিয়তে আছেন। অযোগ্যদের পরিবর্তে যোগ্য লোককেই কোম্পানির সিইও হিসেবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি বিআইএ ও আইডিআরএকে করে দিতে হবে।
বীমাশিল্পে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হলে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে শিল্পের স্বার্থে এবং কারো কথায় প্ররোচিত না হয়ে প্রাথমিকভাবে সকল নন-লাইফ বীমা কোম্পানিকে হিসাববিজ্ঞান ও বীমা জ্ঞানসম্পন্ন জনবল দিয়ে বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ফার্ম দিয়ে অডিট করিয়ে কোন কোম্পানির কী সমস্যা আছে তা চিহ্নিত করে বাস্তবমুখী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়, আমি গত ৩০ মে ২০২১ তারিখে আমার কোম্পানির এক পরিচালকের পরামর্শে তাঁর পরিচিত এক গ্রুপ অব কোম্পানিজ ভিজিট করি। আলোচনান্তে জানতে পারি, সে গ্রুপে ১ম প্রজন্মের তিনটি, ২য় প্রজন্মের একটি এবং ৩য় প্রজন্মের একটি কোম্পানিসহ মোট ৫টি বীমা কোম্পানি সেখানে বীমা ব্যবসা করে। তাদের কমিশন হিসাবে অর্ধশত শতাংশে প্রিমিয়ামের টাকা ফেরত দেয়া হয় এবং কোনো ক্ষতি হলে বীমা কভার না থাকলেও বীমা কোম্পানি কাগজপত্র তৈরি করে অনৈতিকভাবে তাদের প্রাপ্যের চেয়েও অনেক বেশি টাকার দাবি পরিশোধ করে থাকে। এই কথা শোনার পর লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে যায়। ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অত্যন্ত সমীহের সাথে আমাকে মৃদু হেসে বললেন, আপনি কী করতে পারবেন? আমি অবাক হয়ে বললাম, আমার পরিচালক মহোদয়ের সাথে কথা বলে আপনাদেরকে পরে জানাবো। ১ম প্রজন্মের যে সকল বীমা কোম্পানি নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, তারা যদি এই ধরনের অনৈতিক কাজ করে বীমা পেশাকে কলুষিত করে, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই পেশা কতটুকু ভালো হবে এবং কেনই-বা তারা বীমা পেশায় আসবে, তা আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বীমাশিল্পের লোক এবং একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস। তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য উপযুক্ত মেম্বার ও পরিচালক ও নির্বাহীরা রয়েছেন। তা ছাড়া অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নিজেই বলেছেন, আমার কোম্পানি অন্যায় করলে তা সামনে নিয়ে আসুন। আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় একজন চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস এবং বীমাশিল্পের লোক। তিনিও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি চান। এতো কিছুর পরও বীমাশিল্প ভালো হতে বাধা কোথায় তা ভাবার বিষয়। তা সত্ত্বেও সকল বীমা কোম্পানি অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকবলের মাধ্যমে অডিট করিয়ে নিম্নোল্লিখিত বিষয়গুলোর রহস্য কী, তা খতিয়ে দেখতে হবে:
১। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ইস্যুকৃত ৬৪নং সার্কুলার জারির পরও নির্ধারিত হিসাবের বাইরে অতিরিক্ত হিসাব পরিচালনার মাধ্যমে কোন কোন কোম্পানি কীভাবে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
২। ৮৪নং সার্কুলারের পরেও মার্কেটে কী প্রক্রিয়ায় শূন্য কমিশন এখনো অর্ধশত পার্সেন্টেজে কাজ চলছে।
৩। কারা অস্বচ্ছ দাবির মাধ্যমে বীমা কোম্পানি থেকে টাকা লোপাট করে বীমা গ্রহীতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করছে।
৪। কারা আইডিআরএ’র ট্যারিফ রেট ভায়োলেট করে কম রেটে বীমা গ্রহীতাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অন্যের ব্যবসা ছিনিয়ে নিচ্ছে।
৫। কারা স্ট্যাম্প অ্যাক্টের মাধ্যমে বীমা গ্রহীতাদের সুবিধা দিয়ে স্ট্যাম্পের টাকা ফাঁকি দিচ্ছে।
৬ ড্যামি কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে কোম্পানি থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, যা খতিয়ে দেখতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে বীমা পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন। আর তাই বীমাশিল্পে বঙ্গবন্ধুর যোগদানকে অবিস্মরণীয় করে রাখতে তিনি ২০২০ সালে ‘১ মার্চ বীমা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটা বীমা পেশাজীবীদের জন্য বড় অর্জন। আমরা যেন এই অর্জনকে মøান না করি।
তাছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি জনাব শেখ কবির হোসেন প্রতিনিয়ত বীমাশিল্পে শৃঙ্খলা আনয়নে তার সহযোগীদের নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মাননীয় অর্থমন্ত্রী, বিআইএ’র নেতৃবৃন্দ, আইডিআরএ’র বিচক্ষণ চেয়ারম্যান ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। বীমাশিল্পের পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারা যদি সৎ ও স্বচ্ছতার পরিচয় দেন এবং লোভকে সংবরণ করেন। তাহলে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সঠিক বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই আসুন, আমরা যারা মাঠে-ময়দানে কাজ করি, ঐক্যবদ্ধভাবে নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আন্তরিকতার পরিচয় দেই।
Posted ৬:২৯ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৬ জুন ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy