বিশেষ প্রতিবেদন | রবিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩ | প্রিন্ট | 191 বার পঠিত
কর্পোরেট সুশাসন পরিপালনের অভাবে আইন লঙ্ঘনের মাত্রা বেড়েছে বীমা খাতের প্রতিষ্ঠান নর্দার্ণ ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে। প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত কোম্পানি আইন, মূলধন ও শেয়ারধারণ সম্পর্কিত বীমা আইন, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড (ডব্লিউপিপিএ) সম্পর্কিত শ্রম আইন, বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অডিন্যান্স, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত কর্পোরেট গর্ভন্যান্স কোড লঙ্ঘন করে যাচ্ছে বছরে পর বছর। আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি রয়েছে আর্থিক অনিয়ম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও অতিরিক্ত কমিশন দেয়ার মতো ভয়াবহ অভিযোগ।
সর্বশেষ নর্দার্ণ ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিএসইসি’র করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড-২০১৮ (সিজিসি) অনুযায়ী নির্ধারিত সংখ্যক স্বতন্ত্র পরিচালক নেই। সিজিসি’র শর্ত ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদে ১৪ জন পরিচালকের বিপরীতে স্বতন্ত্র পরিচালক মাত্র দুইজন এবং ২০২১ সালেও একই চিত্র ছিল। কিন্তু কর্পোরেট গর্ভন্যান্স কোড-২০১৮ অনুযায়ী, ১৪ জনের বিপরীতে ৪ জন স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিএসইসি মাইনোরিটি শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করতে কর্পোরেট গর্ভন্যান্স কোড (সিজিসি) ২০১৮ সালের ১০ জুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্যে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে স্বতন্ত্র পরিচালকের গুরুত্ব ও দায়িত্ব কর্তব্যের বস্তুনিষ্ঠতা বুঝাতে প্রথম দফার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই এ সম্পর্কিত বিধান পরিপালনের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনায় বলা হয়, প্রতি চারজন পরিচালকের বিপরীতে একজন স্বতন্ত্র পরিচালক রাখতে হবে। এছাড়া পরিচালকদের সংখ্যা চারজনের কম যে কোনো সংখ্যা হলে তাদের জন্যও একজন স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতে হবে। সংক্ষেপে বলা যায়, পাঁচ ভাগের একভাগ স্বতন্ত্র পরিচালক থাকতে হবে এবং চারজন বা চারজনের কম যে কোনো সংখ্যার বিপরীতে আরেকজন স্বতন্ত্র পরিচালক বাধ্যতামূলক রাখতে হবে। কোড পরিপালন করতে নর্দার্ণ ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে আরো দুইজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া, সিজিসি-২০১৮ অমান্যের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিএসইসি। বিএসইসি’র প্রজ্ঞাপন (ঝঊঈ/ঈগজজঈউ/২০০৯-১৯৩/০৮) মোতাবেক কোন প্রতিষ্ঠান কোড অমান্য করলে প্রতিষ্ঠানকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবনমনসহ তালিকাচ্যুত করার ইখতিয়ার রয়েছে কমিশনের।
এদিকে, স্বতন্ত্র পরিচালক বিষয়ে নর্দার্ণ ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বীমা আইন অনুসারে তারা দুইজন স্বতন্ত্র পরিচালক রেখেছেন এবং প্রতিবেদনে সিজিসি পরিপালন না করেও পরিপালনের ঘরে টিক চিহ্ন ব্যবহার করেছেন। কোম্পানির এরূপ কর্মকান্ড ও বক্তব্যকে অযৌক্তিক ও অবান্তর বলছেন আইন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, ‘স্বতন্ত্র পরিচালক সংক্রান্ত নির্দেশনাটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ২সিসির আওতাভুক্ত। তাই এই আইনের সাথে সাংঘর্ষিক অন্য আইন থাকলে তাকে সুপারসিড (রহিত) করে বিএসইসির আইন। ফলে বীমা আইনে যাই থাক না কেন, যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তাই বিএসইসির অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ২সিসির ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে এটি বীমা আইনকে সুপারসিড করে। ফলে এখানে বীমা আইনের দোহাই দেয়া আইনসঙ্গত নয়। এছাড়া, আইন পরিপালন না করেও পরিপালনের ঘরে টিক চিহ্ন দিয়ে বিএসইসি’র আইনের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ।
বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম’র কাছে কর্পোরেট গভন্যান্স কোড-২০১৮ পরিপালনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, যখন কোন প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজার থেকে মুলধন গ্রহণ করে তখন সেই প্রতিষ্ঠান বিএসইসি’র আইন মানতে বাধ্য। তালিকাভুক্ত না হওয়া যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো তাদের মাদার আইন মেনে চলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তালিকাভুক্তির পর বিএসইসি’র আইন ও কর্পোরেট গর্ভন্যান্স কোডকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
সিজিসি অমান্যের বিষয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালক স্বল্পতায় নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তারা বলেন, মাইনোরিটি শেয়ারহোল্ডাররা যেহেতু কোম্পানি পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে না তাদের মুখপাত্র হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় স্বতন্ত্র পরিচালক। মাইনোরিটি শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে আইন মেনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ না করে নর্দার্ণ ইসলামী ইন্স্যুরেন্স একদিকে যেমন আইন অমান্য করেছে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ফেলেছে ঝুঁকির মুখে। বিএসইসি’র কর্পোরেট গভন্যান্স কোড -২০১৮ অমান্য করার কারণে যদি শাস্তির বিধান কার্যকর করে বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বর্তমান পর্ষদেরও। এছাড়া, সিজিসির শর্ত পরিপালনের ঘরে অযাচিতভাবে টিক চিহ্ন দিয়ে কোম্পানি সচিব নিজেদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা ও কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, অনেক বিনিয়োগকারী কোম্পানির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পর্ষদের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, যেকোন কোম্পানির সি-স্যুাট অর্থাৎ কোম্পানি সচিব (সিএস), প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও), ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) মনিটরিংয়ের অভাবে সিজিসি’র শর্তগুলো পরিপালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। সিজিসি পরিপালন করে নির্ধারিত সংখ্যাক স্বতন্ত্র পরিচালক রাখতে নর্দার্ণ ইসলামী ইন্স্যুরেন্সকে বাধ্য করার বিষয়ে বিএসইসি’র প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তারা বলেন, মাইনোরিটি শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থে কাজ করে, প্রতিষ্ঠান অনিয়ম দুর্নীতি রোধে ভূমিকা পালন রাখে এরকম স্বতন্ত্র পরিচালক প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই থাকা দরকার। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের আত্মীয়করণের কারণে সেটা সঠিকভাবে পালন করা যায় না। সাসটেইনেবল পুঁজিবাজার গঠনে বিএসইসি’র এসব বিষয়ে কঠোর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
এদিকে নর্দার্ণ ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী গোলাম ফারুককে ফোনে না পেয়ে কোম্পানি সচিব এম এইচ গালিবের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা’র (আইডিআরএ) আইন মেনে স্বতন্ত্র পরিচালক রেখেছি, বিএসইসি’র আইন মানতে বাধ্য নই। বিএসইসি আমাদেরকে আইন অমান্যের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তাদের কাছে জবাব দিবো বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
Posted ৮:২৭ অপরাহ্ণ | রবিবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy