রজত রায় | রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 92 বার পঠিত
এই মুহূর্তে পৃথিবীর অর্থনীতিটা টিমে তালে চলছে। ঠিক মন্দা হয়ত আসেনি, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি যে হারে বাড়ছিল, সেই হারে আর বাড়ছে না। বিনিয়োগও নিম্নগামী। উন্নতির মন্থর রেলগাড়ি অর্থশাস্ত্রে ছোটখাট প্রহেলিকার অভাব নেই, কিন্তু প্রকৃত বিচারে থাকে রহস্য বলা চলে তেমন ধাঁধার সংখ্যা দু’একটার বেশি নয়। এই কতিপয় রহস্যের মধ্যে সম্ভবত সব থেকে বেশি চর্চিত রহস্য অর্থনীতির ওঠাপড়া।
কখনও কখনও হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে ওঠে বাজার, বেচাকেনা বেড়ে যায়, অবিশ্রাম ঘুরতে থাকে কল-কারখানার চাকা, চাকরিও সহজলভ্য হয়, বাড়তে থাকে মুজুরি, আয়, বিনিয়োগ, আবার কখনও কখনও কমে আসে জিনিসপত্রের চাহিদা, ক্রেতার অভাবে দোকানদার দোকানে বসে আছে, পাড়ার মোড়ে ভিড় বাড়ে বেকারদের, যাদের কাজ আছে তারাও ভয়ে ভয়ে থাকে এই বুঝি চাকরিটা চলে গেল। বিশেষ করে আমাদের দেশে, যেখানে সাধারণ মানুষের না আছে বেকার ভাতা, না আছে দুর্দিনের জন্য সঞ্চয় করে রাখা পর্যন্ত টাকা পয়সা। রহস্যই বটে! মন্দা কখন আসবে তা কেহ সঠিক জানে না আবার কখন ভাল সময় আসবে বা আবার আসলে কতদিন বা স্থায়ী হবে সেই সুসময়।
বিজ্ঞানীরা যেমন সঠিকভাবে বলতে পারে না কখন কোথায় ভূমিকম্প হবে, আর যেটুকু বলতে পারেন সেটা এতটাই ক্রুটিযুক্ত যে তা দিয়ে বিশেষ কাজ হয় না। জোয়ার-মন্দা ভবিষ্যৎবাণী করার ব্যাপারে অর্থশাস্ত্রীদের তেমনই অপারঙ্গমতা। সব থেকে বড় কথা, অর্থনীতিতে কেন মন্দা আসে? কেনই বা জোয়ার! এ নিয়ে তাদের মধ্যে মতান্তর লেগেই আছে।
অর্থভান্ডার পৃথিবীর দেশগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। বৃহত্তম চার এবং বাকি বিশ্ব। বৃহত্তম চারে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরো অঞ্চল, চীন ও জাপান। এদের সম্মিলিত উৎপাদন সারা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি। বাকি বিশ্বের মধ্যে আবার ভারত, ব্রাজিল, রাশিয়া , মেক্সিকো ইত্যাদি বড় বাজারওলা উদীয়মান দেশগুলিকে অন্যান্য স্বল্প আয়ের উন্নতিশীল দেশগুলির থেকে আলাদা করা হয়েছে। অর্থভান্ডারের তথ্য অনুযায়ী সারা পৃথিবীর সম্মিলিত বৃদ্ধিহার যতটা কমেছে, বৃহত্তম চারটি দেশের আয় বৃদ্ধির হার ততটা কমেনি।
অর্থভান্ডারের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০১৯ সালে বৃহত্তম চারের বৃদ্ধিহার ৩ দশমিক ৫ শতাংশের কিছু বেশি। অপরপক্ষে রাশিয়া, সৌদি আরব, মেক্সিকো বা ব্রাজিল এর মতো কয়েকটি উদীয়মান অর্থনীতির বৃদ্ধিহার ১ শতাংশের নীচে নেমে গেছে। তাহলে বিশ্বব্যাপী এই আর্থিক ঝিমুনির প্রধান কারণ কি? অর্থভান্ডারের বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীজুড়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমে আসা। এটা ঠিক যে, এখন চারদিকে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে একটা হাওয়া উঠেছে। সেই আবেগের একটা বর্হিপ্রকাশ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে শুল্কযুদ্ধ আর একটা বেক্সিট। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের শুল্কযুদ্ধের ফলে দুই দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গভীর ভাবে মার খেয়েছে। বেক্সিটের ফলে থমকে গেছে ব্রিটেনের সঙ্গে ইউরো অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর স্বাভাবিক অর্থনৈতিক লেনদেন। শুল্কযুদ্ধ বা বেক্সিটের কারণে শুধু যে চীন, আমেরিকা, ব্রিটেন কিংবা ইউরোপ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাই নয়, এদের সঙ্গে যারা বাণিজ্য করে তারাও আর্থিক নিম্নগামীতার শিকার হয়েছে। এছাড়া উদীয়মান কিংবা উন্নতিশীল দেশগুলোতে তাদের নিজস্ব কিছু সমস্যাও আছে। কোথাও যুদ্ধ চলছে, কোথাও বৈদেশিক ঋণ এত বেড়ে গেছে যে সরকারের উপর আস্থা হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ, কোথাও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ফাটল দেখা দিয়েছে, আবার কোথাও পরিবেশ সংক্রান্ত আইন উদ্যোগপতিদের ওপর এতটাই চেপে বসেছে যে তারা নতুন বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। এই দেশভিত্তিক সমস্যাগুলো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আর্থিক বৃদ্ধি অনেকটাই ব্যাহত করছে।
বিনিয়োগ ও শিল্পে প্রবৃদ্ধি দুর্বল এবং সাম্প্রতিক বন্যার ফলে কৃষিতে মাঝারি মানের প্রবৃদ্ধি হবে। এসব কারণে প্রবৃদ্ধি কম হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আইএমএফ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে ২২ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
তাহলে আগামী অর্থবছরে কি বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে? সম্প্রতি ‘‘নেভিগেটিং বাংলাদেশে’স ক্রস রোডস’’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রতিষ্ঠানটির গ্লোবাল রিসার্চ এশিয়ার সহ প্রধান ফ্রেডেরিক নিউম্যান বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি উন্নতির কারণে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়বে, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়লে বাংলাদেশের অনেক পরিবারের ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়বে। বৃহত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ফলে আগামী অর্থবছরেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হবে। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাজুক পরিস্থিতি চলছে। এটি গত দুই বছরের ধারাবাহিক চিত্র। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক দেরীতে হলেও গত অর্থবছর থেকে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছে। ফলে ব্যাংকের তারল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর প্রভাব পড়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মধ্যে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষি ও সেবা খাতের বিভিন্ন পর্যায়ে বিনিয়োগ কমে যায়। কাজ হারাতে থাকেন অনেক শ্রমিক।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা অন্তবর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। সরকারি হিসাব বলছে, দুই বছরের বেশি সময় দেশের গড় মজুরীর চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি। বাংলাদেশের পেশা খাত তিনভাগে ভাগ করা হয়। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দুটি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অক্টোবর শেষে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। দেশে এখনো মজুরীর চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি।
একই সময়ে দেশের শিল্প খাতও ধুঁকছে। গ্যাস বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন না হওয়ায় ব্যাঘাত ঘটেছে শিল্প খাতের উৎপাদনে। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের কৃষকরা উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদন করলেও নিজের জন্য কিছুই রাখেন না। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে উৎপাদিত ফসল মাঠেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে কৃষক যে খাদ্য ফলান, একটি পর্যায়ে গিয়ে সে খাদ্যই বেশি দামে কিনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক।
বর্তমান অর্থনৈতিক শ্লথগতির প্রধান কারণ দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থিক বাজারের অস্থিতিশীলতা। ব্যাংকগুলোর পাহাড়-প্রমাণ অনাদায়ী ঋণ তার ধাক্কা এখনো ব্যাংকগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন ২০২৪ পর্যন্ত ব্যাংকে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তাছাড়া ব্যাংক ব্যতিত অন্যান্য যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা ধার দেয় তাদের অবস্থাও ভালো নয়। এই অবস্থায় ধার দেয়ার ব্যাপারে ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্টানগুলো অতিরিক্ত সাবধান হয়ে গেছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা ধার চেয়ে পাচ্ছেন না। তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দেশের আর্থিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে, বৃদ্ধির হার কমছে।
ব্যাংক ঋণ কমে যাবার বিকল্প একটা ব্যাখ্যা আছে। সেটা হল, ব্যাংক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে গিয়ে কম ধার দিচ্ছে তা নয়, বিনিয়োগকারীরাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কম ধার চাইছে। কম ধার চাচ্ছে তা কারণ বাজারে জিনিসপত্রের চাহিদা নেই, তাই বিনিয়োগ করেও লাভ নেই । অর্থাৎ এই বিকল্প ব্যাখ্যা ঋণ যোগানের ঘাটতি নয়, ঋণ চাহিদার ঘাটতির ওপর জোর দিচ্ছে। যে ঘাটতির উদ্ভব ঘটছে জিনিসপত্রের চাহিদার অভাব থেকে। কিন্তু বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমে যাচ্ছে কিন্তু কেন?
অনিবার্য প্রশ্ন ওঠে, বেশ তো সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, হঠাৎ কী এমন ঘটল যাতে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমে যেতে লাগল? প্রশ্নটা গভীর, যেহেতু চাহিদার অভাবের কথা বলা হয়েছে তাহলে বোঝা দরকার জিনিসপত্রের চাহিদাটা মূলত কোথা থেকে আসছে। জিনিসপত্র এক রকম নয়, অনেক রকম। এক এক রকম জিনিসের এক-এক ধরণের ক্রেতা। আয়ের নিরিখে একেবারে তলার দিকে যারা রয়েছেন তাদের চাহিদার তালিকায় রয়েছে একেবারে মৌলিক ভোগ্যপণ্য খাদ্য, বাসস্থান, জামাকাপড়, কম দামের তেল-সাবান, বাসনপত্র, প্লাস্টিকের মগ, বালতি, সাইকেল। আজকাল গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌছেছে তাই গরীব মানুষও ইলেকট্রিক পাখা কিনছেন। তাছাড়া মোবাইল ফোন তো এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এই নীচের তলার ক্রেতারা সকলেই অসংগটিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। কেহ দিনমজুর , কেহ রিক্সা চালায়, কারও হয়ত ছোট এক চিলতে চাষের জমি আছ্।ে যারা শহর কিংবা মফস্বলে থাকেন তারা কেহ ফুটপাতে বা অন্যের খোলা জমিতে দোকান দিয়েছেন।
একটা সময় ছিল যখন অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে যারা আয় করতেন তারা তাদের ভোগ্য পণ্যগুলো অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকেই ক্রয় করতেন। অর্থাৎ তারা যে জিনিসগুলো ব্যবহার করতেন সেগুলো মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রেই তৈরি হত। দিনকাল পাল্টে গিয়েছে। সংগঠিত ক্ষেত্রের বড় বড় কোম্পানীরা গ্রাম ও মফস্বলের বাজারে প্রবলভাবে প্রবেশ করেছে। তেল-সাবান হোক বিস্কুট-লজেন্স বা চায়ের সরঞ্জাম গ্রাম মফস্বলের বাজারের প্রায় সবটাই এখন বড় বড় কোম্পানীদের দখলে। ফলে ধনীদের আয় বাড়ছে। ধনীদের আয় বাড়লে দেশে জিনিসপত্রের চাহিদা ততটা বাড়ে না। কারণ সেই আয়ের একটা বড় অংশ ধনীরা সঞ্চয় করেন, কিংবা খরচ করলেও সেটা বিদেশী জিনিসের ওপর খরচ করেন ফলে সামগ্রিকভাবে দেশী জিনিসের ওপর খরচ সামান্যই বাড়ে। এর মানে হল অর্থনৈতিক বৈষম্য যত বাড়ে, অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে দরিদ্রের হাতে জাতীয় আয়ের যত কম অংশ যায়, তত সামগ্রিকভাবে চাহিদার অভাবে একটা সংকটের সম্ভাবনা তৈরী হয়।
পরিবর্তনের যে দীর্ঘ রাস্তাটা ধরে নতুন ব্যবস্থায় পৌঁছতে হবে সেটি যদি কারো কারো পক্ষে বিশেষ করে গরীব মানুষের পক্ষে, অতিশয় কন্টকপূর্ণ হয়, তাহলে সে দিকটাও গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা প্রয়োজন।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেইল : pkroyrajat2016@gmail.com
Posted ৩:১২ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪
bankbimaarthonity.com | rina sristy