রজত রায় | মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫ | প্রিন্ট | 69 বার পঠিত
কোনো দেশই টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করতে পারে না যদি না তার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত অনুন্নত থাকে। কারণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি সমাজের একেবারে প্রান্তিক স্তরে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতিতে সহায়তা করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদন্ড, যা প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ ব্যবসা গঠন করে এবং বিশ্বব্যাপী ৫০ ভাগেরও বেশি কর্মসংস্থান প্রদান করে। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব স্মল বিজনেস-এর তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর এই ধরনের উদ্যোগগুলো প্রায় ৬৫ হতে ৭০ শতাংশ কর্মসংস্থান তৈরি করে।
এসএমই এর উদ্দেশ্য কি? ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হল ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া। এর নেপথ্যে বেশ কিছু বিষয় কাজ করে। এই ধরনের শিল্প বা উদ্যোগগুলো গরিব মানুষদের ও সামনের সারিতে নিয়ে আসে, দারিদ্রতা দূর করতে সাহায্য করে। যা সর্বোপরি ক্ষুধাভিত্তিক সমস্যার সমাধান করে। ক্ষুধা ও দারিদ্র নিরসনের পাশাপাশ এই শিল্পগুলো সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশ এবং বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবন বা নতুন চিন্তাধারাকে দৃঢ়তা দেয়।
কিভাবে একটি নতুন জীবনের দিশা খুলে দেয়? বলা বাহুল্য, এই ধরনের একটি মাত্র উদ্যোগেই প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জনের কর্মসংস্থান হয়। প্রচুর মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের শিল্পগুলোর উপর। তাই এই ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোগগুলো সর্বদাই উন্নয়নের পক্ষে কাজ করে এবং দারিদ্র্যতা রোধের মূল মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরনের শিল্পগুলো সাধারণত বড় পরিসরেই কাজ করে এবং সমাজের সব থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষকে আয়ের সুযোগ করে দেয়। আরও স্পষ্টভাবে বললে, এই ধরনের শিল্পগুলো মহিলা, যুব, এবং গরিব শ্রেণি বা স্বল্প আয়ের মানুষ, যাদের রোজগার খুবই কম তাদের সমাজে এগিয়ে নিয়ে আসতে সহায়তা করে। অর্থ্যাৎ এর লক্ষই মানুষকে নতুন একটি আয়ের উৎস নতুন একটি জীবনের দিশা খুলে দেয়া।
অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে এসএমই খাত কি প্রভাবিত করে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাপান অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে এসএমই খাতকে কেন্দ্র করে কাজ করেছে। ছোট ছোট প্রযুক্তি নির্ভর কোম্পানিগুলো আজ বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। জাপানের মোট শিল্প উৎপাদনের প্রায় ৫০ শতাংশ আসে এসএমই থেকে। দক্ষিণ কোরিয়া বড় শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা কর্মসূচি চালু করে। ফলে দেশটিতে প্রযুক্তিনির্ভর ছোট কোম্পানি তৈরি হয়, যা পরে বড় শিল্পে রূপ নেয়, এসএমই তাদের মোট কর্মসংস্থানের ৮৭ শতাংশ প্রদান করে। চীনের গ্রামীণ শিল্পায়নের ভিত্তি হলো এসএমই। বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ক্ষুদ্র ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট চীনের অর্থনীতিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে চীনের ৯০ শতাংশ এর বেশি প্রতিষ্ঠান এসএমই। ভারতে এসএমই খাতকে এমএসএমই বলা হয়। এটি ভারতের শিল্প উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ এবং রপ্তানির ৪০ শতাংশ জোগায়।
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হল কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) যা শিল্প ভূখন্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। পরিকল্পনা বিভাগের তথ্য মোতাবেক, সিএমএসএমই গুলো শতকরা ৯০ ভাগ শিল্প ইউনিট এবং শতকরা ৮০ ভাগ শিল্প কর্মসংস্থান তৈরি করে এবং উৎপাদন মূল্য সংযোজনে শতকরা ৪৫ ভাগ অবদান রাখে। এসএমই গুলো বার্ষিক প্রায় শতকরা ৬ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সিএমএসএমই খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমছে কেন? উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিনিয়োগের অভাব ও খেলাপি ঋণের উল্লস্ফনে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে আছে। অর্থনৈতিক মন্দার সাম্প্রতিক এ সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বড় আকারের ঋণ বিতরণ খুব একটা দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতে (সিএমএসএমই) ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকের ঋণ বিতরণের তথ্যে এ খাতে ৩ লাখ ২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। ব্যাংকের মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। আবার এই ২৫ শতাংশের অর্ধেক দিতে হবে কুটির, মাইক্রো (অতিক্ষুদ্র) ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতে। মোট সিএমএসএমই ঋৃণের মধ্যে উৎপাদনশীল শিল্পে অন্তত ৪০ শতাংশ, সেবায় ২৫ শতাংশ এবং বাকি ৩৫ শতাংশ ব্যবসা উপখাতে বিতরণ হবে। নারী উদ্যোগে দিতে হবে অন্তত ১৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বারবারই জোর দেয়া হচ্ছে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতিমালা করে দেয়া হলে ও উদ্যোক্তারা ঋণ পেতে নানা ধরণের বাধার মুখোমুখি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে যে, সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো অনাগ্রহী। এ খাতের উদ্যোক্তাদের মাঝে ছোট অংকের ঋণ বিতরণে যে ব্যবস্থাপনাগত জটিলতা এবং সময় ও অর্থ ব্যয় হয়, সে তুলনায় সমপরিমাণ অর্থ বৃহৎ ঋণ গ্রহীতাকে দিলে তা ব্যাংকের জন্য বেশি লাভজনক।
সিএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি) শিল্প খাতে জোর দেয়া কেন প্রয়োজন? বর্তমানে বাংলাদেশ জনসংখ্যাতান্ত্রিক সুবিধার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সালের পর থেকে কর্মক্ষম জনসংখ্যার আনুপাতিক হার কমতে শুরু করবে। এই জনসম্পদকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রবৃদ্ধি অবশ্যই কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী প্রবৃদ্ধি হতে হবে, যা শুধু শ্রমের ঘনত্ব বৃদ্ধির ওপর নির্ভর করবে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বৃহত্তম চালিকাশক্তি হবে এর উল্লেখযোগ্য অংশ।
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রয়াস চালাচ্ছে। উন্নয়নশীল ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি সিএমএসএমই খাতের ওপর জোর দিয়ে এগিয়েছে। তাছাড়া এসএমই খাত বৃহৎ ও ভারী শিল্পের সহযোগী খাত হিসেবে ও ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশে বিনিয়োগ স্থবির হওয়ায় কর্মসংস্থানে গতিশীলতা নেই। নতুন শিল্প গড়ে না ওঠায় বেকারত্ব ক্রমেই বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থবির কর্মসংস্থানে গতি ফেরাতে হলে সিএমএসএমই খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হতে পারে এই খাতে।
এসএমই খাতে প্রবৃদ্ধির মূল বাধা কী? অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে কেবল গতিশীল রাখাই নয়, বরং এটিকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে দক্ষতা উন্নয়ন করা প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতি যখন কৃষি নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং এবং সেবা খাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে, তখন এই খাতগুলোতে দক্ষতা বৃদ্ধি ব্যতিরেকে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা অসম্ভব। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য অর্থায়নের অভাব সবচেয়ে বড় বাধা, বিশেষ করে দোকান স্থাপন বা বিদ্যমান কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে বাধা দেয়। অন্যান্য প্রধান চ্যালেঞ্জ যেমন আর্থিক প্রণোদনার অভাব, গবেষণা, নকশা এবং সম্মতি, ব্যবস্থাপনা সমস্যা, নীতিগত অসঙ্গতি এবং দ্বৈত কর ব্যবস্থা ও বাধা সৃষ্টি করে। তাই, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে দৈনন্দিন কার্যক্রমের জন্য শক্তিশালী নগদ প্রবাহ বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসএমই গুলো যদি ঋণের নিশ্চিত সুবিধা পায় তাহলে ব্যবসা বৃদ্ধি করতে এবং আরও কর্মী নিয়োগ করতে সক্ষম হবে। যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং শ্রম বাজারকেই উন্নত করবে।
বাংলাদেশে সিএমএসএমই গুলো জিডিপি-তে শতকরা ২৭ ভাগ অবদান রাখে। বিশ্বের বেশিরভাগ উন্নত দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতকরা ৫০ ভাগ এর ও বেশি অবদান এসএমই খাতের। প্রতিবেশী ভারতে এই অনুপাত শতকরা ৬০ ভাগ ভিয়েতনামে শতকরা ৪৫ ভাগ।
এসএমই কীভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে বহুমাত্রিক করতে পারে? শিল্প মন্ত্রণালয় জাতীয় এসএমই নীতি ২০২৫ প্রণীত করেছে। যার লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি-তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) অবদান বর্তমান ২৭ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে উন্নীত করা। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশের ৬০ লাখের বেশি ব্যক্তিগত উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে এর বাহিরে ৮০ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ও কর্মসংস্থানের জন্য সিএমএসএমই তে ঋণ বাড়ানো প্রয়োজন। বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারে এসএমই খাত। এটি শুধু কর্মসংস্থান সৃষ্টি নয়, বরং নতুন আয়ের উৎস তৈরির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে বহুমাত্রিক করবে। যদি সরকার ও বেসরকারি খাত এবং উদ্যোক্তারা সম্মিলিতভাবে কাজ করে, তবে এসএমই খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
লেখক অর্থনীতি বিশ্লেষক
ই-মেইল pkroyrajat2016@gmail.com
Posted ৫:৪৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy