পান্না কুমার রায় রজত | শনিবার, ০৮ মে ২০২১ | প্রিন্ট | 376 বার পঠিত
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, টাকার সংকট যেমন এক ধরনের বিপদ তেমনি অতিরিক্ত তারল্যও সমান বিপদ বয়ে আনে। এভাবে তারল্য বেড়ে যাওয়া আর্থিক খাতের জন্য বড় ধরনের বিপদের পূর্বাভাস। তারা বলেন অতিরিক্ত তারল্য ধরে রেখে ব্যাংকের পোর্ট ফোলিও বড় হলেও দুর্বল হচ্ছে ব্যাংকের ভিত, এমন পরিস্থিতিতে তারল্য কমানোর পদ্ধতি ও কৌশল নিরুপন করা জরুরী।
কোভিড-১৯ এর কারণে বর্তমানে ব্যবসা করার মতো পরিস্থিতি আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের নেই। যে কারণে ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্যের জোয়ার বইলে ও ঋণের চাহিদা নেই। গত ডিসেম্বর-২০২০ পর্যন্ত দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ডিসেম্বর-২০২০ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর । এই সময়ে সরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৮৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর ২২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে বিদেশী ব্যাংকগুলোতে।
এতদিন অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ হতো সরকারি বিল বন্ড বা কলমানি বাজারে কিন্তু, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদহার নেমে এসেছে ১ শতাংশের নীচে। ট্রেজারি বিলের মতো সুদহার কমেছে বন্ডে ও । ২ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ৩ শতাংশ নেমে এসেছে। আর চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারে সুদহার নেমেছে ১ শতাংশ।
করেনাকালে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে কিন্তু, অতিরিক্ত তারল্য বিনিয়োগ করার মতো কোন রূপরেখা এ মুহুর্তে নেই। এই পরিস্থিতিতে আমানতের সুদহার কমানোর মাধ্যমে ক্ষতি পোষানো হতে পারে। আমানতকারীরা এ মুহুর্তে নামমাত্র সুদ পাচ্ছেন। অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংক খাতকে কষ্ঠ দিচ্ছে। যে পরিমান আমানত আসছে সেই পরিমাণ বিনিয়োগ হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোর আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও দেশে বর্তমানে বড় ধরনের কোন শিল্প উদ্যোগ নেই বললেই চলে। বড় উদ্যোক্তা ও ভালো ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক খাতে অলস তারল্যের পাহাড় সৃষ্টি হচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতির কারনে অনেক খাতের পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে গেছে। ফলে, নতুন বিনিয়োগ দূরে থাক বিদ্যমান উৎপাদনের সক্ষমতাও পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। কারন অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি বজায় থাকলে এ অর্থ বিনিয়োগ হত। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, করোনা সংক্রমণ শুরু হলে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়াতে বিভিন্ন প্রনোদনা, বেসরকারি খাতে সাম্প্রতিক গতিধারা এবং শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ার পরিসংখ্যান ও বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিফলিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত অর্থ বছরে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বে-সরকারি খাতে ঋণ বেড়েছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। এটি গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। চলতি অর্থ বছরেও বেসরকারি খাতে ঋণের অবস্থা খারাপ । গত ডিসেম্বর-২০২০ পর্যন্ত ১১ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষমাত্রার বিপরীতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এটি স্মরণকালের সর্বনিম্ন । অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে ২০২০-২০২১ সনে জুলাই-ডিসেম্বর শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৩৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। কারখানা সম্প্রসারণ, সংস্কার ও নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। শুধু মূলধনী যন্ত্রপাতিই নয়, এ সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমেছে প্রায় ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ, এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ।
২০২০ সালে বিশ^ বাণিজ্য কমে গেছে শতকরা ১০ ভাগ, যা ২০০৯ সালে বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দার সময়ের কাছাকাছি। আর ২০২১ সালে বিশ^বাণিজ্য শতকরা ৫৭ ভাগ কমবে বলে আশংকা করেছে আই এম এফ । বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত দাঁড়িয়ে আছে তৈরি পোষাক খাতের ওপরে। কোভিড-১৯ থেকে উদ্ধৃত বিশ^ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এই তৈরি পোষাক খাত সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলো শতকরা ৬০-৭০ ভাগ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের দেশ ২০২০ সালে ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় শতকরা ৩০ ভাগ কম কার্যাদেশ পেয়েছে, এবং ইউরোপ ও আমেরিকায় তৈরি পোষাকের বিক্রি যথাক্রমে শতকরা ৯-১৩ ভাগ কমে গেছে। বিশ^জুড়ে রেমিটেন্স হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে তা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে শতকরা ৪৮ দশমিক ৫৪ ভাগ। এই রেমিটেন্স বাড়ার কারন ছিল সরকার ঘোষিত শতকরা ২ ভাগ প্রনোদনা ও অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে মানুষের অর্থ পাঠাতে না পারার জন্য ।
২০২১ সালের চ্যালেঞ্জ ব্যাংক ব্যবসায়ের মুনাফার হার ধরে রাখা । ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার বেঁধে দেওয়া হলেও আমানতের সুদের হার বেঁধে দেওয়া হয়নি । শুরুতে এক ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে অন্য ব্যাংকে আমানত নেওয়ার প্রবনতা থাকলেও এখন সুদের হারে একটা শৃংখলা ফিরে এসেছে। সব ব্যাংকেই বড় ও ভালো কর্পোরেট ঋণ দিতে চায় । দেশের বড় বড় কর্পোরেটগুলো যে পরিমাণ ঋণের প্রয়োজন, ব্যাংকগুলো মিলে তার কয়েকগুন বেশি ঋণের অনুমোদন বাস্তবায়িত করতে চায় । ফলে, কর্পোরেট ঋণ সহজেই খেলাপী হয় না, সংকটে পড়লে এক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যাংকে ঋণ পরিশোধ করে। এই সব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে দর কষাকষির সুযোগ থাকে বিধায় কোন কোন ব্যাংক তাদের শতকরা ৬ থেকে ৭ ভাগ হারে ঋণ দিচ্ছে । প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে অন্য ব্যাংকগুলোও ঋণের সুদহার কমাতে বাধ্য হচ্ছে। অধিকাংশ ব্যাংকের সিংহভাগ ঋণই এ সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া, ফলে ব্যাংকগুলো সুদ আয় ২০২১ সালে অনেক কমে যেতে পারে এবং অনেক ব্যাংক ক্ষতির মুখে পড়ে ক্যাপিটাল হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
কেন্দ্রিয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে একের পর এক নির্দেশনা আসছে। অতিরিক্ত, রেগুলেশন ও আর্থিক খাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকের তারল্য নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোর সি আর আর বা নগদ সংরক্ষণের হার শতকরা ৫ দশমিক ৫ ভাগ থেকে কমিয়ে শতকরা ৪ ভাগ করেছে, ফলে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত প্রায় ১ হাজার ৮ শত কোটি টাকার তারল্য নিশ্চিত হয়েছে। এর পাশাপাশি রেপো সুদ হার শতকরা ৬ থেকে নেমে শতকরা ৪ দশমিক ৭৫ ভাগ তারল্য প্রবাহকে আর ও সুসংহত করেছে।
কোভিড-১৯ ব্যাংকগুলোর সামনে এ বাস্তবতা তুলে ধরেছে যে, পূর্বে ব্যাংকগুলো যেভাবে কাজ করত সেই গতানুগতিক ধারায় চললে ২০২১ সালের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে। ব্যাংকের আয় ধরে রাখতে হলে কস্ট অব ফান্ড কমাতেই হবে। ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় কমিয়ে এবং নন-ফান্ডেড আয় বাড়িয়ে মোট আয় ধরে রাখতে হবে। তেমনিভাবে ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে বলে আমি মনে করি।
কোভিড-১৯ একদিকে আমাদের আর্থ সামাজিক অবস্থানের ওপর যেমন আঘাত হেনেছে, আমাদের প্রিয়জনদের কেড়ে নিয়েছে, অন্যদিকে এটা আবার আমাদের রেজিল্যান্স বা সহনশীলতার একটা এসিড টেষ্ট ও বটে। কোভিড-১৯ আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে হোম অফিস করেও উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা যায়, কীভাবে জুম বা অন্যান্য অ্যাপের মাধ্যমে কাজ করা যায়। ব্যাংগুলো ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে গ্রাহক সেবা বৃদ্ধি করেছে। ঘরে বসে ব্যাংক হিসাব খোলা থেকে শুরু করে জরুরী লেনদেন কেনাকাটা এমনকি ঋণ প্রদানের মতো গুরুত্বপূর্ন গ্রাহকসেবা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ই-কমার্স এখন যে কোন সময়ের চেয়ে জনপ্রিয় এবং ই-কমার্স এ লেনদেন ব্যাপক বেড়েছে ।
বাংলাদেশে পুঁজিবাজার ও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকের তারল্য বৃদ্ধি ও আমানতের সুদ হার কমে যাওয়া এবং সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে মানুষ পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকছে। ব্যাংকগুলো ও পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে এগিয়ে এসেছে যা সামগ্রিক পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক।
করোনা ও অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে ব্যাংকই গুরুত্বপূর্ন ভরসা । ২০২১ সালের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার পাশাপাশি আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর আর্থ সামাজিক উন্নয়নে ঐতিহাসিক ভূমিকার পরিচয় দিতে হবে।
Posted ২:৪৩ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৮ মে ২০২১
bankbimaarthonity.com | rina sristy