পান্না কুমার রায় রজত | মঙ্গলবার, ০২ আগস্ট ২০২২ | প্রিন্ট | 365 বার পঠিত
করোনা মহামারীর পর জীবন জীবিকার বিপুল অনিশ্চয়তায় যখন দেশের একটি বৃহত্তর অংশের মানুষ প্রতিনিয়ত লড়ে চলছে অস্তিত্ত্ব রক্ষার লড়াই ঠিক সেই সময়ে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতির হার এবং বিশেষত ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচকের উর্ধ্বগতি প্রবণতা জনকল্যাণের ধারাকে প্রতিনিয়ত চরমভাবে ব্যাহত করে চলছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ বহুমাত্রিক। প্রথমত দেশি বিদেশি বাজারে কাঁচামালের দামের উর্ধ্বগতি ও অপ্রতুলতা উৎপাদন শিল্পকে বিপাকে ফেলেছে। উৎপাদনের জন্য আমাদের কাঁচামাল বা অন্তর্বতী পণ্য বিদেশ হতে আমদানি করতে হয় ফলে, মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব দেশের বাজারে পড়ে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে কেন্দ্রিয় ব্যাংক সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করলেও আর্থিক বৃদ্ধির উপর বিভিন্ন ধরণের প্রভাব পড়তে পারে। সুদের হার বাড়ানো মানেই বিনিয়োগের খরচ বেড়ে যাওয়া। কারণ, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে সাধারণ গ্রাহক বা কোন কোম্পানিকে বেশি সুদ বহণ করতে হবে।
এমনিতেই অতিমারীকালে দেশে বিনিয়োগ ব্যাহত হয়েছিল। সুদ বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগ কমে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষের আয় কমবে, ক্রমানুসারে তার প্রভাব পড়বে ক্রয় ক্ষমতার উপরে। জিনিষপত্রের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে দরিদ্রতর পরিবারগুলো। তাই পণ্যের দামের ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা শুধু আর্থিক বাজারের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পণ্যের দাম বাড়ার কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যে সমস্যা হয় তা কমানোর জন্যেও প্রয়োজন।
বাধাহীন বিশ^ায়ন ও মুক্তবাণিজ্য সম্প্রসারণের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি আজ ধ্বংস হতে চলছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশের গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে দারিদ্রতা, তীব্রভাবে ব্যাহত হয়েছে কৃষি উৎপাদন। কোনো কোনো এলাকায় রপ্তানি নির্ভর শিল্প আর কৃষি সরাসরি জড়িয়েছে সংঘাতে। মহামারী করোনা আর সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করেছে। কৃষিবাজারও খাদ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে কৃষি পণ্যের দাম বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। বিশ^ব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। কিছু আমদানি নির্ভর দেশ অভ্যন্তরীণ খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই, মুক্তবাণিজ্য উদারীকরণ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।
১৯ জুলাই ২০২২ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জুন মাসের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এক মাসের মূল্যস্ফীতির এত বড় উল্লস্ফন গত কয়েক বছরে দেখা যায়নি। অর্থাৎ বিগত ৯ বছরে এই জুন মাসের মতো এতো মূল্যস্ফীতি আর হয়নি। গত চার পাঁচ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশে পাশে ছিল। মে মাসে ৭ শতাংশ পেরিয়ে গেল। নিত্যপণ্য চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি এতটা বেড়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায় জুন মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাস ভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। মে মাসে যা ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। গত কয়েক মাসের মতো গ্রামে শহরের চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। শহরে হয়েছে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ । জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে এই হার ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এর অর্থ হলো ২০২১ সালের জুন মাসে খাদ্য পণ্য বা খাবারের জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, ২০২২ সালের জুন মাসে সেই পণ্য বা সেবার জন্য ১০৭ টাকা ৫৬ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। এই মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ । এর অর্থ হলো, ২০২১ সালের জুন মাসে খাদ্যপণ্য বা খাবারের জন্য ১০০ টাকা খরচ করতে হতো চলতি বছরের জুন মাসে সেই খাবারের জন্য ১০৮ টাকা ৩৭ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
উৎপাদন বেশি আমদানি কম এমন বেশ কিছু কৌশল নিয়ে চীনের শিল্প খাত সফলতা এনে দিয়েছে। ২০২০ সালে গোল্ডম্যান শ্যাকস একটি গবেষণা প্রকাশ করেন। যেখানে দেখা গেছে, উচ্চ প্রযুক্তির পণ্যগুলোতে চীনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ব্যাপকভাবে উন্নতি করছে। নিজেরাই নিজেদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে। বিদেশ থেকে প্রযুক্তি পণ্য আমদানি করতে হয় না বললেই চলে। ২০০২ সালের দিকে চীন ছিল অল্প কিছু দেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক অংশীদার। এখন ৬০টির বেশি দেশের বড় ব্যবসায়িক অংশীদার দেশটি। ১৯৮৫ থেকে ২০১৫ সালে আমেরিকায় চীনের পণ্য রপ্তানি উল্লেখ্যযোগ্য হারে বাড়ে। এ সময় মোট ১২৫টি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়। এর ফলে ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশটির উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি বাড়ে উল্লেখযোগ্য হারে। পশ্চিমা দেশ রাশিয়ার উপরে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আর্থিক নিষেধাজ্ঞার ফলে বৈশ্বিক জিডিপি বা বিশ্বের মোট উৎপাদনের উপর কী প্রভাব পড়বে তা সময়ই বলে দিবে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রেও দেশটির ক্রেতাদের এখন আগের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। গত এপ্রিলেও যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম যা ছিল, মে মাসে তা ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশটিতে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্য ও জ্বালানির দাম। ১৯৮১ সালের পর এবারই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের এত চড়া মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিবারের মাসে গড়ে ৪৬০ ডলার খরচ হয়। চলতি মাসে এই খরচের হার কয়েকগুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন মুডি‘স অ্যানালিটিকসের মূখ্য অর্থনীতিবিদ। গত বছরের তুলনায় জ¦ালানি খরচ বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে গ্যাসের দাম গত বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। শুধু গ্যাস নয় বিদ্যুতের দাম গত ১২ মাসে বেড়েছে ১২ শতাংশ। ২০০৬ সালের পর বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম মন্ত্রণালয় বলছে, নিত্যকার জীবনযাপনে যে পণ্য লাগে তার সবগুলোর দামই বেড়েছে। দেশটির একটি পরিবারের খাবারের জন্য মাথাপিছু ব্যয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ যা ১৯৭৯ সালের পর সর্বোচ্চ। ডিমের দাম বেড়েছে ৩২ দশমিক ২ শতাংশ, দুধ ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ। দ্য শেল্টার ইনডেক্স বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন খরচ বেড়েছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ যা ১৯৯১ সালের পর সর্বোচ্চ। সাধারণ নাগরিকদের এখন আবাসনের পেছনেই উপার্জনের সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। মহামারীর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এভিয়েশন ব্যবসা বড় রকমের ধাক্কা খায়। করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করায় এভিয়েশন কোম্পানিগুলো আশা করেছিল গত দুই বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে । কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেই আশা আর পূরণ হচ্ছে না।
মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) তাদের মূল সুদের হার ০.৫ শতাংশ পয়েন্ট বাড়িয়েছে। ইউরো জোনের দেশগুলোতে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে এবার ১১ বছরের মধ্যে প্রথম সুদের হার বাড়িয়েছে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি)। ইউরো জোনে মুদ্্রাস্ফীতি বেড়ে দাড়িঁয়েছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং কোভিড মহামারীর কারণে জ¦ালানি, খাবারের দাম বেড়ে গেছে। এতে মানুষের জীবন যাত্রার ওপর চাপ বেড়েছে এবং অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। কারণ (ইইউ) দেশগুলো প্রচন্ডভাবে রাশিয়ার তেল এবং গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির প্রেক্ষাপটে মস্কো জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে বলে দেশগুলো উদ্বিগ্ন।
যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ছন্দপতন ঘটেছে তার মধ্যে আমাদের দেশের অর্থব্যবস্থাকে যতটুকু নিরাপদ রেখে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া যায় তার পথ খুঁজে বের করতে হবে। যাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ যথাসাধ্য কম হয়। বিশেষ করে শিল্প ও কৃষির উৎপাদনের ধারা স্বাভাবিক রাখতে হবে। কীভাবে রেমিট্যান্স আরও বাড়ানো যায় সেদিকে জোর দিতে হবে। বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমে আসছে। তাই সরকার কঠোর মনিটরিং সিস্টেম কার্যকর করে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরবরাহ ব্যবস্থা মসৃণ করতে হবে। যে সব আমদানি পণ্যের দাম এখনও বেশি সেসব পণ্যের ক্ষেত্রে সরকার কর ছাড় দিতে পারে। নিম্ন আয়ের মানুষ যাতে কম মূল্যে পণ্য পায় এ জন্য টিসিবির ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি বাড়াতে হবে। একদিকে বৈশ্বিক সংকট ও দেশের গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটে আমাদের জঠিল সমস্যা তৈরি হলে সামনে আমাদের সময়টা আরো নেতিবাচক ধাক্কার প্রভাব পড়তে পারে। তাই, আমাদের দেশের পণ্য বা সেবার বাড়তি চাহিদা সেটা পূরণ করতে হবে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আমাদের নিম্ন আয়ের মানুষ বা স্থির আয়ের মানুষ তারা যেসব পণ্য ভোগ করে তাদেরকে দুর্বিসহ করে তুলবে। সেই জন্য সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনায়ও মনোযোগী হতে হবে।
Posted ১২:০১ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০২ আগস্ট ২০২২
bankbimaarthonity.com | rina sristy