পান্না কুমার রায় রজত | রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট | 400 বার পঠিত
করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ^জুড়ে বেড়েই চলেছে খাদ্য ও জ¦ালানির দাম। ইতিমধ্যে অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির রেকর্ড হয়েছে। জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সাধারন মানুষকে। এ অবস্থায় খাদ্য ও জ¦ালানির দাম নিয়ন্ত্রণ ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই বিশে^র বিভিন্ন দেশে হচ্ছে বিক্ষোভ সংঘাত। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর এক খবরে বলা হয়েছে, খাদ্য ও জ¦ালানি মূল্য বৃদ্ধির কারণে রাস্তায় বিক্ষোভে নামছে মানুষ। গত সেপ্টেম্বরে ইতালিতে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ পুড়িয়ে বিক্ষোভ করে মানুষ। গত অক্টোবর ২০২২ জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ন্ত্রণে সরকারের নিস্ক্রিয়তার অভিযোগে ফ্রান্সে বিক্ষোভ করে হাজার হাজার লোক। গত নভেম্বরে মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে রাস্তায় নামে ফ্রান্সের কর্মীরা। ব্রিটেনে মজুরী বৃদ্ধির দাবীতে প্রথমবারের মতো নজিরবিহীন বিক্ষোভ করেছেন নার্সরা। ওয়াশিংটন ভিত্তিক আমেরিকার ইউনিভার্সিটির উন্নয়নের রাজনীতির বিশেষজ্ঞ নাওমি হোসেন বলেন, ঐতিহাসিকভাবেই খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের বেশি ক্ষোভের জন্ম দেয়। কিন্তু জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধিও এখন বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে প্রকাশ করা গ্লোবাল রিকস রিপোর্টে বিশ^ব্যাংক জানিয়েছে, আগামী দুই বছর পর্যন্ত খাদ্য ও জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।
সারা বিশ্বে চলছে এখন ডলার সংকট। বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ডলার সংকটের কারণে আমদানি-রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও ব্যয়ে কৃচ্ছ সাধনে বিভিন্ন মূখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে ঋণ বা আর্থিক সহায়তা নেয়া বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়। কিন্তু আইএমএফের এই তহবিল নিয়ে এত আলোচনা কেন হচ্ছে? আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নীতিগত বিষয়ে সংস্কারের কিছু শর্ত দিয়ে থাকে। আর্থিক খাতের সংস্কারের এসব শর্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক সময় জনগণের দুর্দশা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেই আশঙ্কায় সরকার সহজেই ঋণ নিতে চায় না।
বাংলাদেশ ১৯৭২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের একটি সদস্য দেশ। এর আগে একাধিকবার এই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিলেও তা কখনো ১০০ কোটি ডলারের সীমা অতিক্রম করেনি। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২২৮ কোটি ৮ লাখ ডলার। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে টাকার অঙ্কে (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে) ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি হিসাবে এই ঋণের পরিমাণ ১৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এই তথ্য। আইএমএফের মতে, এই ঋণের পরিমাণ ঝুঁকি সীমার মধ্যেই রয়েছে। মোট সরকারি ঋণের মধ্যে বৈদেশিক ঋণের অংশ ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ ।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়। সাধারণত যখন কোন দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় রকমের ঘাটতি তৈরি হয় তখন আইএমএফের দ্বারস্থ হতে হয়। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যখন কোন দেশ ঘাটতিতে পড়ে। যখন বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষত ডলারের ঘাটতি তৈরি হয় তখন আইএমএফ ঋণ দিয়ে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে আইএমএফ। ঋণ অনুমোদনের পরে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সংস্থাটির বিশ্লেষণে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার, যা জিডিপির মোট ৮ শতাংশের বেশি। অন্য দিকে দ্বিপক্ষীয় বা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৬৭ কোটি ডলার, যা জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ঋণ স্থিতি রয়েছে বিশ^ব্যাংকের কাছ থেকে ১ হাজার ৮১৬ কোটি ডলার। বিশ^ব্যাংকের পরে সবচেয়ে বেশি ঋণ রয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ১ হাজার ৩২৮ কোটি ডলার। এরপর আছে যথাক্রমে জাপান, রাশিয়া ও চীন। জাপানের ঋণ স্থিতি ৯২৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া রাশিয়া ও চীনের ঋণ রয়েছে যথাক্রমে ৫০৯ কোটি ডলার ও ৪৭৬ কোটি ডলার। আইএমএফের কাছে ঋণের পরিমাণ ৯৮ কোটি ডলার। নতুন করে সংস্থাটির কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। তবে পূর্ণাঙ্গ ঋণ পেতে সময় লাগবে ৪২ মাস। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও সরকারের বড় ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ রয়েছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র হতে। ইতিমধ্যে এই খাতে নেওয়া ঋণের পরিমাণ কমাতে সুপারিশ করেছে আইএমএফ। দেশীয় উৎস হতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩৮৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যা জিডিপির ২২ দশমিক ১ শতাংশ। সার্বিক ঋণের ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ এসেছে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এর মধ্যে ট্রেজারি বিল ৮২৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। ট্রেজারি বন্ড ৩ হাজার ৪৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার, সুকুক ১৯২ কোটি ৬০ লাখ ডলার, জাতীয় সঞ্চয়পত্র হতে ঋণ রয়েছে ৩ হাজার ৯৯১ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ঋণের গ্যারান্টি আকারে রয়েছে ৩১০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর বাইরেও অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ রয়েছে ৬৭১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
আইএমএফ থেকে অর্থ নেওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের ভাষ্য হচ্ছে, বিশ্ববাজারে অভূতপূর্ব হারে জ¦ালানি তেল, খাদ্যপণ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কোভিডের ক্ষত সারিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন বিপদ হিসেবে আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যা অর্থনীতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মে ১১ মাসে আমদানি আগের তুলনায় ৩৯ শতাংশ । বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৮২৩ কোটি ডলারের। এ ছাড়া চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দেয় ১ হাজার ৭২৩ কোটি ডলার। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ২৭৮ কোটি ডলার। আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার অংশ হিসেবে রাজস্ব খাত সংস্কারের কথা রয়েছে। অর্থাৎ শুল্ক ও কর অব্যাহতি না দেওয়া বা কমানোর শর্তটি অন্যতম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিল্প, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে কোনো ভ্যাট নাই। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে এমন খাতগুলোতে ভ্যাট আরোপ করা নেই। উৎপাদন খাতে পোশাক শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। এ ছাড়া বিদেশি পণ্যের নির্ভরতা কমিয়ে দেশি শিল্পের বিকাশ, টেকসই শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার এয়ারকন্ডিশনার,লিফট, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাচাঁমাল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে এবং ক্ষেত্রবিশেষ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া আছে। অর্থাৎ প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রায় ৫০০ পণ্যকে বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতাভুক্ত। এ সুবিধা থাকায় ভ্যাট জিডিপির তথা কর জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না। আইএমএফের শর্ত মেনে কাজ করলে আমাদের অর্থনীতি পূনরুজ্জীবিত হবে তা ঠিক। তবে আইএমএফের কিছু শর্ত আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে আমাদের অর্থনীতির জন্য একটু হলেও সমস্যা হতে পারে। আমরা যেভাবে আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশ যা চেয়েছিল তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ অনুমোদন করেছে বহুজাতিক এই প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ চেয়েছিল ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার কিন্তু ঋণ প্রদানকারী সংস্থার নির্বাহী বোর্ড অনুমোদন করেছে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। বহুল আলোচিত ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রি. ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলারের ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় হয়েছে। ৪২ মাসে ছাড় যোগ্য ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণ তিনটি প্যাকেজে বিভক্ত। অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিতে ‘‘সহায়তা হিসেবে আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ)” থেকে ৩৩০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া আইএমএফের নবগঠিত রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাস্টেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় বাংলাদেশ পাবে ১৪০ কোটি ডলার। বাংলাদেশই প্রথম এশীয় দেশ, এই তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে। ঋণের প্রথমোক্ত অংশটি সুদমুক্ত, সাড়ে ৫ বছর পারিতোষিক কালসহ পরবর্তী ১০ বছরে পরিশোধযোগ্য। দ্বিতীয়াংশে উল্লেখিত অংশটিও ১০ বছরে পরিশোধযোগ্য, তবে পারিতোষিক কাল সাড়ে ৩ বছর। আর শেষাংশে উল্লেখিত নতুন অংশটির পরিমাণ ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার যা ২০ বছরে পরিশোধযোগ্য, আর পারিতোষিক কাল ১০ বছর। সুদযোগ্য ঋণাংশে সুদ মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। বৈশি^ক অর্থনীতির এই কঠিন সময়ে এত অল্প সুদে এ রকম দীর্ঘ সময়ের জন্য এই রকম ঋণ পাওয়াটা দেশের জন্য অবশ্যই একটা বড় অর্জন। এ ঋণ প্রাপ্তিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। যা কোনো সংকটের আশংকা থাকলেও সেটি মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করবে। এ ঋণ পাওয়ার পর অন্যান্য সংস্থা থেকে ঋণ পেতে এখন আর তেমন যাচাইয়ের দরকার হবে না। কেননা সার্বিক অর্থনীতির চুল ছেড়া বিশ্লেষণ করে আইএমএফ কোন দেশকে ঋণ দেয়।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ অনুমোদনের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিশ^ব্যাংক। এ ছাড়া এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বিনিয়োগ ও অবকাঠামো খাতে ঋণ সহায়তা বাড়ানোর ঘোষণা ইতিমধ্যে দিয়েছে। এই বার্তাটি বর্হিবিশে^ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।
Posted ১২:০৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৯ মার্চ ২০২৩
bankbimaarthonity.com | rina sristy