ড. হোসেন জিল্লুর রহমান | রবিবার, ১৬ জুন ২০১৯ | প্রিন্ট | 611 বার পঠিত
বাজেটে চমক বা খুব বেশি নতুনত্ব নেই। ভেবেছিলাম নতুন অর্থমন্ত্রী এসেছেন, নতুন কিছু করবেন বা বড় সংস্কারের প্রস্তাব দেবেন। বাস্তবে তা হলো না। এবারের বাজেটও আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতারই অংশ। চলতি মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী রয়েছেন। অর্থমন্ত্রী নিজে ব্যবসায়ী, ব্যক্তি খাত উপদেষ্টা ব্যবসায়ী, বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী। আরো কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি আছেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেটে আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার বাইরে কিছু দেখার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সেটি একেবারেই পূরণ হয়নি। মোটামুটি আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার ভিত্তির মধ্যেই রয়ে গেছে বাজেট প্রস্তাব। এর মধ্যে ছোটখাটো নতুন কিছু বিষয় সংযোজন করা হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে আমলাতান্ত্রিক ছাপেরই প্রতিফলন ঘটেছে। নতুনত্বের জায়গায় তেমন কোনো বদল ঘটেনি। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিল, শস্যবীমা প্রবর্তন এবং নদীভাঙন মোকাবেলার জন্য থোক বরাদ্দ ধরনের কিছু কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে। কাজেই এটি মোটামুটি আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার মধ্যেই আছে।
লক্ষণীয়, চার-পাঁচটি চ্যালেঞ্জ যে আমাদের অর্থনীতিতে রয়েছে, সেগুলো মোকাবেলার জন্য জোরালো পরিকল্পনা বা কৌশলগত চিন্তার ঘাটতি দেখা গেছে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখতে পাই, ঘুরেফিরে চলতি অর্থবছরেও আমাদের প্রবৃদ্ধি চালক তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স। এ দুটো থেকে বেরোতে পারছি না। বলতে গেলে, ব্যক্তিভোগ ও তৈরি পোশাক দুটো মিলেই প্রবৃদ্ধি যা হয়েছে, তার একটা ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রবৃদ্ধির এ দুটি চালক গত তিন দশক ধরে চলছে। এখানে নতুন প্রবৃদ্ধি চালক তৈরির যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সেটি মোকাবেলার পরিকল্পনা উঠে আসেনি প্রস্তাবিত বাজেটে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে বটে। ঠিক সার্বিক চিন্তার কোনো জায়গা দেখিনি। এটি একটি বিষয়।
আরেকটি বিষয়, আমরা অব্যাহতভাবে দেখতে পাচ্ছি যে প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি ক্রমে কম দরিদ্রবান্ধব হচ্ছে। মানে দারিদ্র্য বিমোচন স্থিতিস্থাপকতার যে প্রবৃদ্ধি ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, সেটি কমে গেছে। এখানে একটি চিন্তার ব্যাপার ছিল—এটি কীভাবে মোকাবেলা করা হবে কিংবা এটা অ্যাড্রেস করার জন্য নতুন চিন্তা কী হতে পারে। এখানেও তেমন কিছু দেখা যায়নি। তৃতীয় বড় বিষয় বৈষম্য। বর্ধমান বৈষম্য মোকাবেলার সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। বৈষম্য আসলে তৈরি হয় কীভাবে? সামাজিক নিরাপত্তা খাত কিছুটা সম্প্রসারণ হয়েছে, যদিও আনুপাতিক হারে বরং একটু কমেছে। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তা খাতের যে চারটি উপখাত আছে যেমন মৌসুমি বেকারত্ব, দুর্যোগ সহায়তা, অক্ষমতার শিকার জনগোষ্ঠী (বৃদ্ধ, বিধবা, প্রতিবন্ধী) এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রভৃতিতে নতুন চিন্তার দৈন্য সুস্পষ্ট। বিশেষত মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাথমিক উপবৃত্তি বা অন্যান্য কর্মসূচিতে গতানুগতিকতার বাইরে নতুন কিছু দেখিনি। স্বাস্থ্য খাতেও একই অবস্থা। এ খাতে নতুন চিন্তার খুবই প্রয়োজন ছিল বিশেষত এ বাজেটে। কারণ এটি মানবসম্পদ উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত। শুধু স্বাস্থ্যসেবা হিসেবে নয়। আমরা জানি যে স্বাস্থ্য খরচের ধাক্কায় চার-পাঁচ মিলিয়ন লোক আরো দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এখানেও ঘাটতি দৃশ্যমান। আসলে বৈষম্যের বিষয়টি কীভাবে সামলানো হবে, তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই।
বৈষম্য বৃদ্ধির চালকগুলো লক্ষ করুন। এর একটি হলো, আমাদের যে রাজস্ব আহরণ হচ্ছে, তার বেশির ভাগই পরোক্ষ কর। এটা নিবর্তনমূলক (রিগ্রেসিভ)। পরোক্ষ করের বোঝাটা মূলত নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের ওপর। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত যে কম তা নয়, কর কাঠামোও নিবর্তনমূলক। মানে কর রাজস্বের বিপুল অংশই হলো পরোক্ষ কর বা ভ্যাট। এটি কিন্তু বৈষম্য বাড়ানোর হাতিয়ার। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের বিষয়টি এক ধরনের আলোচনা করি বটে কিন্তু সার্বিকভাবে তা বিশ্লেষণ করি না। ঋণখেলাপির বিষয়টি মূলত ব্যাংকের সুশাসনের সঙ্গে যোগ করে কথা বলি। তবে এখানেও বৈষম্যের একটি চালকের দিক আছে। ব্যাংকগুলো আমানত নিচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। সেই আমানতটা লুটপাট করছেন খেলাপিরা। সেদিক থেকে নিবর্তনমূলক করের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর যেমন বোঝাটা বেশি হচ্ছে, ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই হচ্ছে। ব্যাংকগুলো আমানত নিচ্ছে সাধারণ মানুষ থেকে কিন্তু ঋণটা যাদের কাছে যাচ্ছে, তারা আবার ঋণখেলাপি। শুধু কালো টাকা সাদা করা নয়, রাষ্ট্র তথা সরকার সার্বিকভাবে ঋণখেলাপির বিষয়ে জোরালো কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ নেয়নি। আবারো বলব, ঋণখেলাপি শুধু অর্থনৈতিক সুশাসনের বিষয় নয়, বৈষম্য বাড়ানোর একটি ক্ষেত্রও বটে। আর প্রবৃদ্ধির নতুন চালক তৈরি না হওয়াও দেশে বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম অনুঘটক।
চিন্তার জায়গা থেকে আরেকটি বড় ঘাটতি মনে হয়েছে। আর তা হলো, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে তার অন্যতম প্রকাশ হতে হবে মানবসম্পদ উন্নয়নে অধিক গুরুত্ব দেয়া। আমাদের অর্থনীতির এ পর্যন্ত যতদূর অগ্রগতি হয়েছে, তার মূল কারণ সস্তা শ্রম। অর্থাৎ নিম্ন শ্রম ব্যয়ের অর্থনীতি। বড় মাপে যদি চিন্তা করি, আমাদের অর্থনীতির কী ধরনের রূপান্তর প্রয়োজন? তাহলে প্রথমেই আসবে কম মূল্যের কর্মশক্তিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে দক্ষ ও উৎপাদনশীল জনশক্তিভিত্তিক অর্থনীতিতে উত্তরণ। এ ধরনের চিন্তারও প্রকাশ দেখা যায়নি প্রস্তাবিত বাজেটে। এখন যেহেতু নীতিনির্ধারণী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত দলে ব্যবসায়ী মহল রয়েছে, সেহেতু আশা ছিল বাজেটে ব্যক্তি খাত বিকাশের নতুন দিকনির্দেশনা দেখতে পাব। কিন্তু সেটি দেখা যায়নি। বরং দেখা গেছে আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার মধ্যে গোষ্ঠীস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। এ বাজেটে এটি আরো বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
এদিকে দাম বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটে কৃষি খাতে বাস্তবমুখী কিছু পরিকল্পনার কথা শোনাটা খুব বেশি দুরাশার ছিল না। কিন্তু সেটি হয়নি। বরং এক্ষেত্রে টুকটাক নতুনত্বের একটি চমক হলো শস্যবীমার চিন্তা। কৃষকের দাম না পাওয়ার ফলে যে ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে আপাতভাবে শস্যবীমা তুলনামূলক চমত্কার কর্মসূচি। তবে তার বাস্তবায়ন সহজ নয় এবং বাজেটে এ ধরনের কোনো নির্দেশনাও নেই। প্রাসঙ্গিক একটি উদাহরণ দেয়া যাক। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) ২০০৯ সালে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করা হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, অর্থায়নের একটি বড় সমাধান সেখান থেকে আসবে। ১০ বছর পরে আমরা দেখি যে এক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। শস্যবীমার ক্ষেত্রেও এটি হতে পারে। শস্যবীমা বাস্তবায়ন কঠিন প্রকল্প। কৃষকের জন্য এটি বলা যায় জনতুষ্টিমূলক। ঘোষণার মধ্যে একটু চমক আছে অনেকটা সেই ধরনের। কাজেই তাতে আশান্বিত হওয়ার খুব বেশি কিছু নেই।
মোদ্দা কথা হলো, এবারের বাজেটেও আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাই মূল সুর। কিন্তু অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে যে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ (যেমন আর্থিক ঝুঁকি কমানো, বৈষম্য মোকাবেলা, নতুন প্রবৃদ্ধি চালক তৈরি করা, প্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়াকে দরিদ্রবান্ধব করা) বিরাজমান, সেগুলো মোকাবেলায় বলিষ্ঠ কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এগুলো অ্যাড্রেস করার বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা বা কৌশলগত চিন্তার অনুপস্থিতি দেখেছি প্রস্তাবিত বাজেটে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি
Posted ৩:৫৬ অপরাহ্ণ | রবিবার, ১৬ জুন ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed