মোহাম্মদ আবু নোমান | বুধবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | প্রিন্ট | 1126 বার পঠিত
ছেলে আর টাকা পাঠাতে পারে না। তাই গর্ভধারিণী বৃদ্ধা মা মনোয়ারা বেগম অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালান। এই মায়েরই সন্তান জাহালম যিনি ব্যাংক, দুদক, পুলিশ ও আদালত, সবার কাছেই ‘আবু সালেক’ নামের ধুরন্ধর, ঝানু ব্যাংক জালিয়াতকারী! যিনি কোনো রকম বাংলায় শুধু নিজের নামটুকু লিখতে পারেন। দুদকের চিঠিতে বলা হয়, ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এই জাহালম; যিনি ইংরেজিতে নিজের নামও লিখতে পারেন না। জাহালমের স্ত্রীও কারখানার শ্রমিক। ভাবা যায়! ব্যাংক, দুদক, পুলিশ, আদালত- এই চার প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, বিচক্ষণ, বিজ্ঞতাপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের ভেরিফিকেশনের পরও আসামি হয়ে নিরাপরাধ জাহালমকে তিন বছর জেলে থাকতে হলো? তাহলে ঘটনা কিছুটা রহস্যময় মনে হচ্ছে নাতো? জাহালমের এই দুর্ভোগের জন্য যারা দায়ী তারা সালেকের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে এই কাজ করেনি তো?
একটা গল্পে আছে, বনের মধ্য দিয়ে এক শিয়াল দৌড়াচ্ছিল। বাঘ দেখে বলল, কী ব্যাপার! কই যান প-িত মশাই? শিয়াল উত্তর দিল, বনের রাজা ‘সিংহ’ সব হাতিদের ধরে ধরে জেলে ভরছে! বাঘ বললো, তুমি তো মিয়া শিয়াল, তোমার চিন্তা কিসের! শিয়াল উত্তরে বলল, সেটা প্রমাণ করতেইতো ১০ বছর লেগে যেতে পারে!
দেশটির নাম বাংলাদেশ। সব সম্ভবের দেশ! ব্যাংক, দুদক আর পুলিশ কি জাগ্রত থেকে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জাহালমের ব্যাংক জালিয়াতির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল? ওয়াকিবহাল সবাই রামায়নের ‘কুম্ভকর্ণ’ নামক চরিত্রটির সঙ্গে পরিচিত। যিনি বছরে ছয় মাস ধরে ঘুমাতো আর বাকি ছয় মাস জেগে থাকতো। যখন ঘুম ভাঙত পাগলের মতো খিদে পেত কুম্ভকর্ণের। হাতের কাছে যা পেত ধরে কপাকপ মুখে চালান করতো। এর মধ্যে মানুষও নিস্তার পেত না। তবে কুম্ভকর্ণ যতই খেয়ে থাকুক না কেন কিছুতেই তার খিদে মিটতো না। তেমনই কুম্ভকর্ণ ধারণকারী দেশের কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা রয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের আটটি জেলার ১১টি সরকারি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে হাসপাতালগুলোতে ৪০ শতাংশ, উপজেলা পর্যায়ে অনুপস্থিতি প্রায় ৬২ শতাংশ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শীর্ষ কর্মকর্তারা মাসের বেশির ভাগ সময়ই অনুপস্থিত থাকেন। অনেকে সপ্তাহে দুই-এক দিন এসে হাজিরা খাতায় সই করে পুরো মাস অনুপস্থিত থাকেন এবং পুরো মাসের বেতন তোলেন।
পরের খবর হলো, চাকরিজীবনের শেষ সপ্তাহেও ঘুষ ছাড়া থাকা গেল না! ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) গিয়াস উদ্দিনের চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ার কথা। জমি খারিজের প্রতিবেদন দেওয়ার বিনিময়ে শহরের স্টেশন রোডের ইতালি ভবনের মালিক শাহ আবদুল হাকিমের কাছ থেকে গিয়াস উদ্দিনসহ কয়েকজন ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। ২৩ জানুয়ারি এ ঘুষের একটি অংশ ১০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার সময় গ্রেপ্তার হন। কে জাহালম আর কে সালেক এরকম একটা পরিচয় নিশ্চিত করা কি এতই কঠিন!
প্রকৃতপক্ষে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আবু সালেক নামের এক লোক, যার সোনালী ব্যাংক ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব রয়েছে। আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির কথা নেই। রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের একটি ভুয়া ঠিকানা। কিন্তু সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল জাহালমের জীবনে।
তারপরও জাহালম ভাগ্যবান যে, ইতিপূর্বে বিনা বিচারে ২৫ বছর কারাভোগের পর বেকসুর খালাস পেয়ে কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের বাহারনগর গ্রামের মো. বাবুলের মতো বলতে হয়নি, ‘কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?’ এ ছাড়াও ১৩ বছর জেল খাটার পর নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া, ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে খালাসের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর আগেই মারা যায় সাতক্ষীরার ওবায়দুর রহমান ওরফে অবেদ আলী। তখন সাতক্ষীরার অবেদ আলীর ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছিল। অবেদ আলীর মৃত্যু ছিল পুরো জাতির জন্য লজ্জা ও কলঙ্কের। খুবই কষ্টদায়ক ঘটনা। যা চরম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। যে অনভূতি ব্যক্ত করার নয়। সে অসহ্য, তিক্ত, বেদনাদায়ক খবর পড়ে এমন কেউ নেউ, যার মন ভারাক্রান্ত না হয়ে থেকেছে।
জাহালমের মা মনোয়ারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বিনা দোষে বিনা অন্যায়তে ব্যাটা আমার জেল খাটছে। ব্যাটার জন্য আমি পঙ্গু হয়ে গেছি। কানতে কানতে এখন আর আমি কানতেও পারি না। ‘মানষে আমার এত বড় সর্বনাশটা করল। মামলা চালাতে গিয়ে ফকির হয়ে গেছি।’বড় ভাই শাহানূর মিয়া আদালতের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে চরম হতাশ হয়ে বলেন, ‘কে শোনে কার কথা। দুদকের ভুলে আজ আমার ভাই তিন বছর ধরে জেলের ঘানি টানছে। কে ফিরিয়ে দেবে আমার ভাইয়ের তিনটি বছর?’
জাহালম জানালেন, বিনা দোষে কারাগারে তার কষ্টে দিন কেটেছে। রাতের বেলা বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তানদের কথা মনে করে কেঁদেছেন। জাহালম আরও বললেন, ‘আমার সব সময় মাথায় একটাই চিন্তা আসত, আমি বোধহয় আর কোনো দিন জেল থেকে বের হতে পারব না।’
দুদকের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাহালম বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ দুদক কর্মকর্তারা জাহালমের কাছে জানতে চান, আবু সালেক নাম দিয়ে তিনি সোনালী ব্যাংকে হিসাব খুলেছিলেন কি না। জাহালম দুদক কর্মকর্তাদের স্পষ্ট করে জানান, সোনালী ব্যাংকে তার কোনো হিসাব বা লেনদেন নেই। তিনি সামান্য বাংলা জানেন। ইংরেজিতে স্বাক্ষরও করতে পারেন না। অভাবে প্রাইমারি স্কুলের চৌকাঠ পেরোতে পারেননি জাহালম। কোনোমতে বাংলায় নিজের নামটা লিখতে পারেন। আবু সালেক নামে ব্যাংকের হিসাবটিও তার না। হিসাব খোলার ফরমে আবু সালেকের যে ছবি, তা-ও তার নয়। অথচ সেদিন দুদকে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা সবাই জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ বলে শনাক্ত করেন।
সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালম গ্রেপ্তার হয়ে কারাগার থাকায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি বলেছেন, এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা। গত ছয়-সাত মাস আগে জানতে পারেন, একজন লোক আরেকজনের নামে জেল খাটছেন। দুদক চেয়ারম্যানের দুঃখ প্রকাশকে সাধুবাদ জানাতে হয়। সচারচর আমাদের দেশে কৃত ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায় না। বরং মিথ্যা কথা বলে ভুলটাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়। ভুল স্বীকার হচ্ছে সঠিক কাজের প্রথম পদক্ষেপ। সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রথাগত অস্বীকার আর অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দুদক চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ। ভুল স্বীকার করে দুদক চেয়ারম্যান বড় হলেন। সবচেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত হবে দায়ীদের আইনের আওতায় আনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেয়া। তারপরও কথা থেকে যায়, ছয় মাস আগে জানা সত্ত্বেও নিরাপরাধ জাহালমকে মুক্ত করায় দীর্ঘ সময় লাগা কিছুতেই কাম্য নয়।
কোনো স্কুলের ছাত্র বা ছাত্রী বোর্ড স্ট্যান্ড করলে কিন্তু সেই স্কুলের নামটাই হয়। তখন সবাই বলে অমুক ছাত্র অমুক স্কুল থেকে স্ট্যান্ড করেছে। তেমনি একটা পরিবারে সন্তান নষ্ট, ভ্রষ্ট হলে তার দায় কি পিতামাতা এড়াতে পারে? দেশে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লেও পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায়। অনেক পুলিশ সদস্য বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেয়ে পকেট ভারী করতে ব্যস্ত। তবে সব পুলিশই যে অন্যায় করে, তা বলা হচ্ছে না। এরকম ঘটনাদৃষ্টে বাহিনীর উপরওয়ালারা নৈতিক দায় এড়াবেন কীভাবে? অপরাধী না হয়েও নামের মিলে জেল ও নিরীহকে ফাঁসানোর ঘটনা ভবিষ্যতে যে আবারো হবে না, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?
সাতক্ষীরার ওবায়দুরের ছেলে শেখ আশিকুর রহমান বলেছিলেন, খালাস আদেশ কারাগারে না পৌঁছানোয় বাবাকে ছয় মাসের বেশি সময় আটক থাকতে হয়। ওবায়দুরের স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন বলেছিলেন, তার স্বামী বিনা দোষে ১৩ বছর জেল খেটেছেন। একজন ব্যক্তিকে নির্দোষ প্রমাণ করতে তেরোটি বছর লাগল? এটাই আশ্চর্য ও বিস্ময়কর! বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা যে কত দুর্বল ও ধীরগতি, সাতক্ষীরার ওবায়দুর, কুমিল্লার বাবুল ও বর্ণিত প্রবন্ধের জাহালম জেল-জুলুমের বিনিময়ে সবার কাছে জানান দিয়ে গেলেন, বিলম্বিত বিচার অবিচারেরই নামান্তর।
লেখক : কলামিস্ট
সূত্র ঃ ঢাকা টাইমস।
Posted ১২:৪৪ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed