মামুন রশীদ | মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০১৯ | প্রিন্ট | 992 বার পঠিত
২০০১ সালে দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পদের জন্য ইন্টারভিউ প্রদানের সময় উপস্থিত বোর্ড মেম্বারদের মধ্য থেকে একজন প্রভাবশালী পরিচালক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমাদের বর্তমান সিইও গত বছর ২০০ কোটি টাকা লাভ করতে সাহায্য করেছেন, আপনি এক্ষেত্রে লাভের অংকে আরো কতটি সংখ্যা যোগ করতে পারবেন?’ সব ক্ষেত্রে বিষয়টি এরূপ না হলেও খানিকটা কাছাকাছি যে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের ব্যাংকিং খাত সংখ্যাগতভাবে প্রায় দুই অংকের মুনাফা ঘরে তুলেছে, টেকসই প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে শেয়ারহোল্ডারদের আকর্ষণীয় রিটার্ন দিয়েছে। কিন্তু মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি কোনো ধরনের শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে তাদের অধিকতর লাভের লোভ ব্যাংক সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করছে। ব্যাংকিং খাতের উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছে এবং তারা বিস্ময় প্রকাশ করছে এই ভেবে যে, আদতে খাতটি কি আমাদের উন্নয়নে কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করছে? আমাদের আর্থিক খাত নিয়ে যে ধরনের কেলেঙ্কারি ছড়িয়েছে, তাতে বিদেশী কোম্পানিগুলোও এখানে বিনিয়োগের বিষয়ে সতর্কতা আরোপ করছে। ফলে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় সহায়ক তহবিল হারাচ্ছি। একইভাবে ব্যাংকিং খাতের হরেক সমস্যার কারণে অভিনব ব্যবসায়িক ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করতে আগ্রহী স্থানীয় উদ্যোক্তারাও যথাযথ আর্থিক বন্দোবস্তের অভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কেলেঙ্কারি: রাজনীতির সঙ্গে ব্যাংকের নির্বাহী ও পরিচালকদের সম্পৃক্ততা ও ব্যাংকের সুনামকে কাজে লাগিয়ে অবৈধ লেনদেনের খবরগুলো কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাংকিং খাতের শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পাঠকরা জেনে অবাক হবেন যে নিজেদের বার্ষিক প্রতিবেদন ও অন্যান্য নথিপত্রে ব্যাংকগুলো যা প্রকাশ করে, তার অনেকটাই মিথ্যা ও অতিশয়োক্তিতে ভরা। ব্যাংক মালিক ও এর পরিচালকদের অগণিত কেলেঙ্কারি ব্যাংকিং খাতকে কলঙ্কিত করেছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমের বরাতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির অনেক ব্যাংকের অবৈধ কার্যক্রমের খবর সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালকরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন কিংবা বিতর্ক এড়াতে অনেককে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ওই পদক্ষেপের সূত্র ধরে আমাদের ব্যাংকিং খাতের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও ব্যাংকগুলোর অনৈতিক অনুশীলনের ফলে বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীরা এখনো আমাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম নিয়ে সন্দিহান। নির্ভরযোগ্য ও সফল আর্থিক খাত গঠনে আমাদের সামনে ব্যাংকিং খাতের এমন অপ্রীতিকর চিত্রের পরিবর্তনই একমাত্র কঠিন কর্ম নয়, ২পি, ৩সি ও ১টি মডেল; ব্যক্তি, পণ্য, কমপ্লায়েন্স, প্রতিযোগিতা, বৈশ্বিক ও স্থানীয় পরিস্থিতিসাপেক্ষে পরিবর্তন ও প্রযুক্তিসহ অনেক কিছুতেই সমস্যা রয়েছে।
অসুস্থ প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতার চিত্র সবচেয়ে ভয়াবহ, যদিও কিছু লোক এটাতে অসম্মতি জানাতে পারে। তবে এটা কোনো সুস্থ প্রতিযোগিতা নয়, যা কিনা সামগ্রিক অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক্ষেত্রে বরং অস্বাস্থ্যকর ও হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা বিদ্যমান, যা অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য অন্তরায়। অর্থনীতিতে কাম্য, প্রতিযোগিতার চেয়ে এটি ভিন্ন, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা ভিন্ন, সচরাচর আমরা যেমনটা দেখি ঠিক তেমন নয়। কিন্তু প্রতিযোগিতায় ‘বাংলাদেশী ব্র্যান্ড’ দেশটির ইতিবাচক বিকাশের ক্ষেত্রে নেহাতই ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করেছে, বরং অসৎ বৃত্তিকে উৎসাহ জুগিয়েছে। অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে প্রতিযোগিতা সুনির্দিষ্ট শর্তাবলির অধীনে সামগ্রিক অর্থনীতিকে ইতিবাচক অর্জনের দিকে পরিচালিত করে। শর্তাবলির মধ্যে রয়েছে নিখুঁত তথ্য (স্বচ্ছতা) ও প্রবেশের বাধা হ্রাস—নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবহেলায় আমাদের ব্যাংকিং খাতে এ দুটি বিষয়েরই অভাব রয়েছে। শুধু অন্যান্য ব্যাংকের সঙ্গে নয়, অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ও মাইক্রো ফিন্যান্স ইনস্টিটিউশনের (এমএফআই) সঙ্গেও ব্যাংকগুলোকে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। এ বিষয়গুলোয় সমন্বয় আনার জন্য কোনো ধরনের কার্যকর কাঠামো কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। কেবল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও গ্রাহকরাও একে অন্যের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। ফলে পরিস্থিতি এতটাই কঠিন হয়েছে যে একদিকে পাথুরে, অন্যদিকে শক্ত কোনো ভূমিতে আটকে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে। গ্রাহক কিন্তু পরিস্থিতি থেকে সেরাটাই নিতে চেষ্টা করবেন, অন্য ব্যাংক বা ব্যাংক দ্বারা প্রদত্ত পরিষেবাটি উল্লেখ করে নিয়ন্ত্রকের প্রয়োজনীয়তাগুলোর সঙ্গে তুলনা করবেন না। প্রতিষ্ঠানের দাবির মুখে ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট গ্রাহক লক্ষ্যমাত্রা পূরণের কাজটি রীতিমতো প্রলোভন ও তোষামোদে পূর্ণ। এভাবে তাদের টিকে থাকার প্রশ্নে প্রবিধানগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একের পর এক নিয়মগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ফলে বিষয়টি অনৈতিক আবর্তনে পরিণত হয়েছে এবং যা এখন অনেকটাই আদর্শ বা নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। ব্যাংকিং খাতের প্রতিযোগিতা আঘাত হানছে পুঁজিবাজারেও। ফলে বড় ব্যাংকগুলো স্বাভাবিকভাবেই তাদের তহবিল বৃদ্ধির জন্য ইকুইটি মার্কেটমুখী হচ্ছে। এটি ব্যাংকগুলোর কোটি টাকার ব্যবসাকেই শুধু প্রভাবিত করছে না, পাশাপাশি বাজার মূলধনে তাদের ভূমিকাকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করছে; যা কিনা ২০০৭ সালে ৫৯ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অস্থির শেয়ারবাজারে মুনাফা অর্জনের চেয়ে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখাটাই এক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে।
এটি তাদের অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। ভিন্ন হলেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা সবাই মনে করি, ব্যাংকিং শিল্পে দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজন, যারা প্রচলিত কাজে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি নতুন ধরনের উদ্ভাবনে দক্ষ হবে। তাই নতুন পণ্য তৈরি ও দক্ষ মানবসম্পদ বিকাশের লক্ষ্যে বাজারের দক্ষতা বৃদ্ধি সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
নিয়ন্ত্রক চ্যালেঞ্জ: মানুষ ও পণ্য ইস্যুতে আমাদের সবসময় পরিবর্তনশীল প্রযুক্তি এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। বাজারের নতুন দিকনির্দেশনাগুলো ব্যাসেল-২ ও অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে। ব্যাসেল-৩ নিয়েও অনেক আলোচনা হচ্ছে। তবে প্রবিধান পরিবর্তনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে হঠাৎ করে নেয়া কোনো সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়নের জন্য নিয়ন্ত্রকরা প্রায়ই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন, পদক্ষেপগুলো বিস্তৃতভাবে বাস্তবায়নে ব্যাংকের সক্ষমতা যাচাইয়ে যথাযথ গবেষণা ছাড়াই অনেকটা কাজে নেমে পড়েন।
ফলে বাস্তবায়নে ধীরগতি, স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে বিভ্রান্তির পাশাপাশি প্রবিধানগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য জন্ম হচ্ছে নতুন নতুন কৌশলের। এর মাধ্যমে যারা নিয়মনীতি মেনে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে ওই চতুর ব্যবস্থাপকদের ভারসাম্য বজায় থাকে না। এক কথায় ‘নন-লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পরিস্থিতি’ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনেক বেশি বিশৃঙ্খলার বিপরীতে নামমাত্র পদক্ষেপ তাদের উদ্দেশ্যগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন লঙ্ঘনে আপনি আশ্চর্য হবেন। অবশেষে প্রশ্ন থেকে যায়, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কে সর্বস্ব খোয়াতে চায়?
তাছাড়া দেশ যখন ভুক্তভোগী তখন প্রতিটি নাগরিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাংকিং খাতকে ঘিরে গর্বিত হওয়ার পাশাপাশি এটি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হতে পারত। কিন্তু বিপরীতভাবে খাতটি জনগণের অর্থে এর মালিকদের পকেট ভারী করতে যেন সর্বোচ্চ চেষ্টায় নিয়োজিত। নিয়ন্ত্রকরা বেশির ভাগ সময়ই সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মগুলো বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণটি হলো, নিম্ন প্রবৃদ্ধিকে মোকাবেলা করতে আমানতকারীদের অর্থ ব্যবহার করে বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন ঝুঁকিপূর্ণ মূলধন বাজারের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল, নিয়ন্ত্রক সংস্থা তখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠনে পদক্ষেপ নেয়। যথাযথ নিয়ম রয়েছে। তবে সমস্যাটা হচ্ছে, সততার সঙ্গে নিয়ম পরিপালনে। নিয়ন্ত্রক ও আইনি ব্যবস্থাগুলো যদি সৎ হতো, তাহলে বারবার একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি না ঘটিয়ে অপকর্মকে প্রতিহত করা সম্ভব হতো।
সম্মুখপানে: টেকসই, লাভজনক ও অগ্রবর্তী ব্যাংকিং খাত তৈরিতে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা। গন্তব্যে পৌঁছতে লক্ষ্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার পাশাপাশি আরো সক্রিয় হতে দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া চাই। এ পর্যায়ে সামগ্রিকভাবে সুশাসন ও জবাবদিহির ক্ষেত্রগুলোয় অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। একটি প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদককে এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার পত্রিকাজুড়ে একের পর এক এত নেতিবাচক শিরোনাম কেন থাকে?’ সম্পাদক সাহেব হেসে উত্তরে বলেছিলেন, ‘আপনারা নেতিবাচক ঘটনা ঘটানো বন্ধ করুন, তাহলে আমাদেরও আর এ ধরনের শিরোনাম দিতে হবে না।’
লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
Posted ১২:১৫ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০১৯
bankbimaarthonity.com | Sajeed